অনমনীয় ও নিরীক্ষাপ্রবণ কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক সেলিম মোরশেদ লেখালেখি করছেন আশির দশকের গোড়া থেকে গাণ্ডীব, অনিন্দ্য, সংবেদ, চর্যাপদ, দ্রষ্টব্য, প্রতিশিল্প, শিরদাঁড়া, জঙশন, সূর্যঘড়ি ছোট কাগজের মাধ্যমেই তার কথাসাহিত্যের চর্চা। চার দশক ধরে ছোট কাগজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত লেখক সাহিত্যের একটা সমাজ বিনির্মাণ করতে চান। সেই সময়ের গল্প-উপন্যাসে যে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ছিল, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তখন প্রায় সবার মধ্যেই নতুন কিছু তৈরির একটা তাগিদ ছিল, সেই তাগিদ এখনকার সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে কম। প্রচলিত গণমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছোট কাগজ আন্দোলন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন, নতুন ধারার চিত্রকলার আন্দোলন, গণমুখী যাত্রা-নাট্যান্দোলন সব কেমন ঝিমিয়ে গেছে। দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি উত্থানের এটাও একটা কারণ। এই মুহূর্তে সেলিম মোরশেদের মতো স্বতন্ত্র পাঠ কিংবা শিল্পমানসম্পন্ন লেখা খুব কম। তার লেখা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিভুক্ত।
রাজনৈতিক সচেতন এই লেখক লেখালেখিকে সমাজের এক ধরনের সমালোচনা মনে করেন। শিল্পের নান্দনিক আনন্দ থেকে তিনি লেখেন, পাঠককে বিনোদিত করার উদ্দেশ্যে নয়।
‘সাপলুডু খেলা’ উপন্যাসের পরতে পরতে এই ছাপ বিদ্যমান, আছে দুর্গম যাত্রার অনুসন্ধিৎসু মানসের কথোপকথন। এখানে ধর্মবোধ, আধ্যাত্মিকতা, সংখ্যাতত্ত্ব ও দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক চেতনা অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে, কাহিনির গৎবাঁধা ছক পেরিয়ে বিচিত্র ঘটনার সংঘটন, যার স্বর অনুচ্চ হলেও বিশ্লেষণ সূক্ষ্মতর এবং অর্কেস্ট্রায়ন যেন একটি নিটোল কাব্য। বাঙালি মুসলমানের মাইনরিটি ডিসকোর্স একপেশে নাকি বহুমুখী, তার চিত্রণ যুক্তিপূর্ণ। রাষ্ট্র যেখানে ধর্মের (পড়ুন ধর্মান্ধ) পৃষ্ঠপোষক, সেখানে অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথাবার্তা নিছক ভাঁড়ামো। রাষ্ট্র বাইরে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম, আর সংবিধানে তৃতীয় রকম। কিন্তু কিছু মানুষ এর বাইরে তারা শিরদাঁড়াসম্পন্ন, তারা মানবতাবাদী। ‘আমি মানুষ। আমার শূন্যতা সত্য।’ হেগেল বা ডুরিং, ফয়েরবাখ, লাসেল কিংবা জ্যঁ পল সার্ত্ররা মানবসত্তার শাশ^ত অনুভূতির পক্ষে তারা গলিপথ থেকে রাজপথ, বস্তি থেকে অট্টালিকায় পরিবর্তনের দিকচিহ্ন সূচিত করেন। বিপদে হিন্দুদের জপ, মুসলমানের ঠোঁটে সুরা, খ্রিস্টানের লর্ড সেভ মি থেকে ‘মা মাগো’ দিয়ে খণ্ডকে অখণ্ডে আনয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু করা যায় এবং তা বেশি ফলপ্রসূ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মের চেয়ে ধর্মীয় লেবাসের শক্তি বেশি, তা মানুষের অবচেতনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। আর তাই বৃষ্টিতে বারুদ ভিজে যাওয়া, ষড়যন্ত্র, সব যুক্তি চাপা পড়ে যায় ছোট হুজুর যখন বলে, হয়রত শাহ জুবায়ের (র.)-এর দোয়া পাওয়ায় ইংরেজরা পলাশির প্রান্তরে জয়লাভ করে। কথায় কথায় কেয়ামতের লক্ষণ, চারদিকে ইহুদি-নাসারাদের যড়যন্ত্র
প্রভৃতি বাক্য বাঙালি মুসলমানের ঠোঁটস্থ, যুক্তিবোধ সেখানে পলায়নপর। বাবর থেকে আওরঙ্গজেবের বিলাসিতা, সমকাম, মানুষ হত্যা জায়েজ হয়ে যায় মসজিদ-খানকা নির্মাণের বদৌলতে। অথচ ইসলাম সমকাম, পরপীড়নের ঘোর বিরোধী। রাজনীতির এই মারণ প্যাঁচ বুঝতে পারার আগেই ফতোয়া ওঠে, ‘মসজিদ বাবা আল্লার ঘর। যে বানিয়েছে তার জীবনে দোষ-ত্রুটি থাকতেই পারে কিন্তু সে কথা বলে মসজিদের পবিত্রতা ক্ষুণœ করতে চাইলে তো ছেড়ে দেওয়া হবে না।’ ওয়াজের নামে মিথ্যাচার, ঘটনার অপব্যাখ্যা, অপতথ্য আর বিদ্বেষমূলক কথাবার্তায় ফেসবুক-ইউটিউব ভরা, যা পুরোপুরি ইসলামের আদর্শবিরোধী। ইসলাম অবমাননার দায় তুলে ব্লাসফেমি আইনে অনেক নিরীহ লোককে (বিশেষ করে হিন্দুদের) গ্রেপ্তার করা হয়, গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়, লুটপাট করা হয়, এমনকি ধর্ষণও। কিন্তু ইসলামের আদর্শবিরোধী কথা যখন তারা ময়দানে বলেন, তখন সেগুলোকে ব্লাসফেমি আইনের আওতায় বিবেচনা করা হয় না। রাষ্ট্র তখন নীরব ভূমিকা পালন করে। কারণ তাদের আছে বিপুল পরিমাণ অনুসারী এবং রাজনৈতিক শক্তি। রাজনীতির নামে রেললাইন উৎপাটন, বোমাবাজি, আগুনসন্ত্রাস আগেও ছিল, এখনো আছে। দেশ এগিয়েছে কেবল চেহারায়, মানুষ এগোয়নি একটুও।
পশ্চিম বাংলার মানুষের ভাষাপ্রেম, সংস্কৃতিচর্চা যুক্তি হীন, সেকেলে। মদ ও মেয়ে টাকার কাছে সহজলভ্য, একটু বেশিই, এখন তা দুই বাংলায় সমানভাবে প্রযোজ্য। কেরু অ্যান্ড কোংয়ের লাভের গ্রাফচার্ট দেখলেই তা বোঝা যায়। সাংবাদিকদের সাংঘাতিক হয়ে ওঠা, রাজনীতিকদের নীতিহীন কর্মে লিপ্ত হওয়ায় সব সেক্টরে ধস নেমেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে বামেদের সুবিধাবাদ, মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের জঙ্গিবাদ হিসেবে দেখানোই সরকার ও পত্রিকার কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ, তবে এটাও মনে রাখতে হবে, যা ঘটে তা কিছু না কিছু বটে। মুক্তিয্ুেদ্ধ রাজাকারদের ভূমিকা, কিছু সাহসী মেয়ের রুখে দাঁড়ানো, পাকিস্তানি আর্মির বর্বরতা ছিল অশেষ, সেই সময়ও। ‘এই যুদ্ধ কাদের পক্ষে? আশরাফদের না ব্রাত্যজনের নাকি মানুষের। যার দিনক্ষণ মাস নেই, প্রতিদিন বিরামহীন। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এমনকি শতাব্দী অবধি।’ সেসব মানুষ, যারা মুক্তিযোদ্ধা, তাদের হাসিরপাত্র বানানো, শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ তালিকায় দেশ বিপর্যস্ত, নবপ্রজন্মও দ্বিধাগ্রস্ত— এই দায় কার?
হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব, বিভেদ, জাত্যাভিমান আজও ক্ষুরধার হিন্দু ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে বেরুতে পারেনি, মুসলমান গণতান্ত্রিক হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি আর নজরুল মুসলিম কবির খেতাবে বন্দি করার মাঝে বহুত আনন্দ। কবিতার মঞ্চও এ থেকে বাদ যায় না। হিন্দু ও মুসলমান মানুষ হওয়া থেকে শত হাত দূরে থাকে। এর জন্য দায়ী কে? ‘সুলতান মাহমুদকে, বখতিয়ার-আওরঙ্গজেবকে, সলিমুল্লাহ-জিন্নাহকে, না সুরেন্দ্রনাথ বা নেহরুকে না ব্রাহ্মণ্যবাদকে নাকি নিজেকে দায়ী করবেন।’
চেতনার জায়গাগুলো যেন প্লাস্টিক হয়ে গেছে। কেমন দ্বিচারিতায় দুষ্ট বাঙালির মন। ফিলিস্তিনের মুসলিম কিংবা ইউঘুর নিধনে বাঙালি শোকাচ্ছন্ন কিন্তু সেই বাঙালি নিজের দেশের অমুসলিম অত্যাচারে নীরব দর্শক, এমনকি মাজারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে
উল্লাস করে, সদলবলে নামাজ পড়ে। এদের ঈশ্বর কেমন?
কোথায় থাকে?
শিশু ও পরিবার, পিতৃত্ব ও ঈশ^র, জ্ঞান ও ভালোবাসা লক্ষ্যমুখী নাকি গন্তব্যহীন? শিল্প ও শিল্পী কীভাবে জড়িত, কেন মানুষ এমন? সর্বত্র দায়বোধের এত অভাব কেন? আত্মহত্যা, খুন, ধর্ষণের উৎসব চলছে দেশে। ক্লাস টু-থ্রির বাচ্চা ধর্ষিত হচ্ছে। বাবা আইনের আশ্রয় নিলে তাকেও মেরে ফেলা হচ্ছে। লেখকের ভাষায়, ‘এমন কুৎসিত ও নৃশংস কাজ একমাত্র বিকলাঙ্গ কীটই করতে পারে।’
ড্রাগ ও সাংবাদিকতা, পুলিশ ও মাফিয়া কিংবা মাফিয়া ও আমলাদের মধ্যে যোগসূত্র গাঢ়তর। এর মধ্যে পড়ে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে মানুষের মত, পথ, নিয়তি পাল্টে যাচ্ছে, অপরাধপ্রবণতার ঊর্ধ্বগামী অভিশাপ মনোজগৎকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। জনগণ ক্ষমতার উৎস আমাদের সরকারগুলো ভুলে যায়, ফলশ্রুতিতে ধেয়ে আসে ৫ আগস্ট।
গরিব দেশগুলোর মানুষ মশা-মাছির মতো, দামহীন, নাম-গোত্রহীন, কেবল মরে যাওয়ার জন্য জন্মায়। ‘যখন তারা তলায় ছিল, বিরামহীন ঢিল ছুড়ল ওপরে। যখনই সামনে আসার সুযোগ পেল, পচনশীল হয়ে গেল।’ মানুষের মধ্যে পিশাচ থাকে, কখনো কখনো তা টের পাওয়া যায়। দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, এনজিওর নামে ছিদ্র হয়ে গেছে দেশের তলা, আমলারা টাকা নিয়ে বিক্রি করছে দেশের তথ্য। রফিক, বরকত, জব্বারের রক্ত, একাত্তরের ত্যাগ-তিতিক্ষা কিছুই কি মনে থাকে না এদের? পৃথিবীর এখন গভীরতর অসুখ এখন, রক্তাক্ত পৃথিবীর শরীর। ইতিহাস সবসময় রক্তের কথা বলে। ‘মানুষ তো রক্তের দিঘিতে ভাসে, এখান থেকে শিকার করে নেয় তার প্রয়োজনীয় আমিষ।’ মার্ক্সীয় সাম্যনীতি, ধর্মীয় শক্তি ব্যর্থ, দুঃশাসন ও শোষণই এখন শাশ্বত সত্য। ‘সাপলুডু খেলা’য় প্রবলভাবে চিন্তা হাজির রাজনৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক ঘটনার সন্নিবেশ, কখনো বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো বা একটার মধ্যে আরেকটা, বিরামহীন পাহাড়যাত্রার অনুভূতি আঁকড়ে ধরে মন ও মজ্জা।
চরিত্র চিত্রণে বিষন্নতার আবহ। সলোমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম চরিত্র : একই সঙ্গে ভীত ও সৌন্দর্যময়, জীবনের সাপলুডু খেলায় জড়িয়ে পড়ে সামনে-পেছনে চলমান, দ্বন্দ্বমুখর চেতনার লড়াইয়ে নিমজ্জিত। বেন, নারীন, সালমা, নীতা, মাসুদ ডাক্তার, শাহাজাহান চাচা, বিষ্ণু বিশ্বাস হঠাৎ মূর্ত হয়ে সামান্য জায়গা নিয়েও করোটির মধ্যে স্বতন্ত্র ও সচ্ছল। কথ্যভাষার সরল অথচ পরস্পরবিরোধী প্রয়োগ, যার বিষয় স্পর্শকাতর; প্রতীচ্যের মানদণ্ডে পাল্লা দিতে সক্ষম। ভাষা গতিশীল ও নান্দনিক, কয়েকটি জায়গায় খাপছাড়া বয়ান, দুর্দান্ত চিত্রকল্পের সমাহার যা সিনেমাটিক স্বচ্ছতায় মনোলোভা। বিরামচিহ্নের সচেতন ও (কিছুটা) অভিনব ব্যবহার, আধুনিক গদ্যরীতি, বিষয় ও বৈভবে, আকৃতিগত বোধের বিস্তৃতি ও গভীরতায় শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাসে রূপ নিয়েছে ‘সাপলুডু খেলা’। অমিয়ভূষণ মজুমদারের আঞ্চলিকতা নয়, বরং উপন্যাসের অবয়বে একটা ‘বৈশ্বিক রঙ’ আছে। ব্যক্তি ও যৌথ, ইতিহাস ও দর্শন, দৈনন্দিন ও চিরায়ত, প্রকৃতি ও কাঠামোর সম্পূর্ণতায় গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের A hundred years of solitude উপন্যাসের মতো একে ‘ক্ষুদ্রায়তনিক সামগ্রিক উপন্যাস’ বলাও যায়।
‘সাপলুডু খেলা’ কোনো ভালো-মন্দ লাগার উপন্যাস নয়, এটা শর্ত, যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর কমপ্লেক্স, আখ্যানের কেন্দ্র ও প্রান্তের ঘূর্ণাবর্ত। উপন্যাসে লেখকের ব্যক্তিজীবনের প্রভাব থাকেই, এ উপন্যাস তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে অনেক দার্শনিক-প্রবণতার উল্লেখ আছে, তাদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলে বিষয় হৃদয়ঙ্গম করা একটু কঠিন। তবে এমন করে মেটাফর, সিম্বল ও মোটিফের প্রেষণ, বিষয় ও প্রকরণগত বৈচিত্র্য এবং সিনট্যাক্স ও ফর্মের সংঘটন কয়জন লেখকে পারেন! এমন করে পুরস্কারকে না-বোধক করে দিতে কয়জনে পারেন!
সেলিম মোরশেদ, চিরকালীন পথ আপনাকে ডাকছে ওই আপনি নির্ভাবনায় থাকুন।