বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পুকুর ইজারায় কোটি টাকার ‘বাণিজ্য’

আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৫ এএম

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সরকারি পুকুর ইজারায় নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ খাতে গত তিন বছরে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া অভিযোগ উপেক্ষা করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পানির দরে পুকুর ইজারা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইজারায় জালিয়াতির আশ্রয়ও নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে শতাধিক খাসপুকুর ইজারায় তিন বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক এমপি আবুল কালাম প্রভাব খাটিয়ে সোনালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড, জনতা, দুরন্ত, সন্ধি, প্রবাহ, দিগন্তসহ ১৭টি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অনুমোদন নেয়। সেখানে প্রকৃত মৎস্যজীবী সদস্য না হলেও তার পছন্দের ৩৪২ সদস্য জেলে নিবন্ধনে নিযুক্ত করা হয়। একই বছর উল্লেখিত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি অবৈধ মর্মে চাপড়াপাড়া, ওড়ানসহ বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তৎকালীন সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ১৭টি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি মারফত ৩৪২ জেলে সদস্যকে উপজেলা কমিটির রেজুল্যুশনের মাধ্যমে নিবন্ধন দেন। কিন্তু সদস্যদের তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়নি এবং অনলাইনে এন্ট্রি করা হয়নি। এ কারণে সেসব জেলের প্রকৃত মৎস্যজীবী হিসেবে এফআইডি প্রদান করা সম্ভব হয়নি। ফলে তারা আজোবধি এফআইডিধারী প্রকৃত মৎস্যজীবী হননি।

অভিযোগ উঠেছে, মৎস্য কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন উপেক্ষা করে জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি উৎকোচ নিয়ে সুকৌশলে ১৭টি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির মধ্যে ১৬টি সমিতির নামে ইজারা দিয়েছেন। এতে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে জলমহাল কমিটির বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি।    

জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ইজারাযোগ্য খাসপুকুর রয়েছে চার শতাধিক। নীতিমালা অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত মৎস্যজীবী সমিতিগুলোকেই খাসপুকুর ইজারা দেওয়ার নিয়ম। বাংলা ১৪৩২-১৪৩৪ সনের জন্য গত ২ জানুয়ারি উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি ২০ একর আয়তনের ১২৮টি খাসপুকুর ইজারার নোটিস জারি করে জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর মধ্যে আদালতে মামলা জটিলতা দেখিয়ে ২৪টি পুকুরের ইজারা স্থগিত করা হয়। তবে কিছু পুকুর ইজারা না দিয়ে খাস কালেকশন করা হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

উপজেলা ভূমি অফিস থেকে গত ১১ মার্চ যোগ্য দরদাতাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে তা আগেই প্রস্তুত এবং স্বাক্ষরিত। ইজারা নোটিসে প্রতিটি পুকুরের সম্ভাব্য সরকারি বার্ষিক ইজারা মূল্য উল্লেখ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ পুকুরই ইজারা দেওয়া হয়েছে সরকারি দরের অনেক কম দামে। 

উপজেলা সহকারী (ভূমি) কমিশনার কার্যালয়ের নাজির কাম ক্যাশিয়ার ধ্রুব চন্দ্র বর্মণ জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে পুকুর ইজারার সব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিনি পুকুর  পেতে সহযোগিতার নামে প্রতিটি সমিতির বিপরীতে অন্তত ১০ হাজার করে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে ধ্রুব চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘আমি ইজারা দেওয়ার কেউ নই। ইজারার বিষয়ে সব দায়িত্ব এসি ল্যান্ড ও ইউএনও মহোদয়ের। আমি শুধু কাগজপত্রে সহযোগিতা করে থাকি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সব বিধি-বিধান মেনেই পুকুর ইজারা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার প্রত্যয়নের ভিত্তিতে এসব পুকুর ইজারা দেওয়া হয়। সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। কম মূল্যে ইজারার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো পুকুর কত টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে সেটা কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।

এ বিষয়ে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক তাকে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তিনি সেভাবেই কাজ করেছেন। কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে সেই দায়ভার তার নয় বলে জানান এ কর্মকর্তা।

অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, পুকুর ইজারায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ডিসি মহোদয়ের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ বলেন, এ রকম কোনো অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত