নির্মল শ্বাসের জন্য নির্মল বাতাস জরুরি। কিন্তু ঢাকার বাতাস কতটা নির্মল? বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় মাঝেমধ্যেই উঠে আসে ঢাকা। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের প্রভাবে বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু লাখের বেশি। ফলে অনুমান করা যায়, নির্মল বায়ুর অভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে আয়ু কমছে এই শহরের মানুষের।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। এ ছাড়া জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব তো রয়েছেই। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কিন্তু কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নয়ছয় হয় নানাভাবে। ফলাফল ‘জীবন বাঁচানোর’ প্রকল্প অকেজো, বায়ুদূষণ আগের মতোই।
রাজধানীর উন্নয়নে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল সরকার। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে এটি শেষ করা হয়েছে ২০১৯ সালের জুনে। এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম, বিদেশ সফর, প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে ওঠে নানা অভিযোগ। প্রকল্পের যন্ত্র কেনা নিয়ে হয় সই জালিয়াতি। ফলে বায়ুদূষণ রোধে বায়ুর মান নির্ধারণ করা তো দূরের কথা, চলেছে অনিয়মের হুলস্থুল।
এখানেই শেষ নয়; বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রকল্পের আওতায় ছিল রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের সড়কে অটো সিগন্যাল, সোলার সিস্টেম, ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ ও ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সড়কের উন্নয়ন। ৪৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ছয় বছর। কিন্তু সেই প্রকল্প শেষ হয়েছে ১১ বছরে। শুধু মেয়াদ বাড়েনি, প্রকল্পে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে। চলতি বছর ৮ এপ্রিল থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) নামে ২০১৯ সালে শেষ হওয়া প্রকল্পটি ছিল একটি আমব্রেলা প্রকল্পের অংশ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় মূল প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৪৪৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫১ কোটি ৮৪ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৩৯৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু তিনবার সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে এটি শেষ করা হয়েছে ২০১৯ সালের জুনে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ৪২৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি ৬ কোটি ৮৩ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণের ৪১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। যদিও প্রকল্পের পুরো ব্যয়ের প্রকল্পের ইতি টানা হলেও প্রকল্পটিতে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির সংগঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই চলতি বছর ৮ এপ্রিল অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান প্রধান করে দুই সদস্যের একটি টিম গঠন করে। টিমের অন্য সদস্য হলেন উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার।
জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধান টিম অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র চেয়ে গত ১৩ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) প্রকল্পসংক্রান্ত ডিপিপি, প্রাক্কলন, প্রকল্পের অনুমোদনপত্র, পত্রিকায় প্রকাশিত টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি, দরপত্র ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন, প্রকল্পের মেয়াদ, বরাদ্দ, প্রকল্প সমাপ্তির পর আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নোটশিটের ফটোকপি দরকার। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব রেকর্ডপত্র ২৪ এপ্রিলের মধ্যে দুদকে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হলো।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, আলোচ্য প্রকল্পটিতে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতি করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রকল্পটি জনস্বার্থে যে উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, এর অনেক কিছুই বাস্তবে কাজে লাগেনি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চার বছর পর প্রস্তাব মূল্যায়ন করে এসব তথ্য উদঘাটন করে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডির তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রকল্পের বেশিরভাগ আউটপুট মুখ থুবড়ে পড়েছে। নেই কোনো মনিটরিং ও জবাবদিহি। এর সঙ্গে জড়িতদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুনে সম্পন্ন করা আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী গুলশান-১ লিংক রোড ইন্টারসেকশন অটো কন্ট্রোল ট্রাফিক সিস্টেম চালু নেই এবং সৌরবিদ্যুৎ অকার্যকর। একই অবস্থা হাউজবিল্ডিং কলোনি ইন্টারসেকশন, ঝিগাতলা, সাতমসজিদ রোড (শংকর) ইন্টারসেকশন এবং বনানী রোড-১১ নম্বর ইন্টারসেকশনে। জসীমউদদীন রোড ইন্টারসেকশনে ফ্লাইওভারের কাজ চলমান থাকায় (ওই সময়) সেখানে এটি চালু নেই। সেখানেও সৌরবিদ্যুৎ অকার্যকর। এ ছাড়া গুলশান-২ রোডে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম চালু থাকলেও সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম অকার্যকর। ফুটওভার ব্রিজ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহজাদপুর ফুটওভার ব্রিজ অবৈধ হকারদের দখলে থাকায় জনগণের চলাচলে সমস্যা হয়। সিঁড়ির উচ্চতা বেশি হওয়ায় বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওঠানামা করতে অসুবিধা হয়। একই অবস্থা বনানী-কাকলী, শ্যামলী, বসুন্ধরা শপিং মল, সোবহানবাগ মসজিদ, নর্দা-বারিধারা বাসস্ট্যান্ড এবং উত্তর বাড্ডা বাজার ফুটওভার ব্রিজের ক্ষেত্রেও। পীরজঙ্গি মাজার, কমলাপুরের ফুটওভার ব্রিজের ল্যান্ডিং সিঁড়ি একপাশে হওয়ায় যাতায়াতে সমস্যায় পড়তে হয়। একই অবস্থা মতিঝিল গভ. বালক উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজে। বনানী-১১ নম্বর রোডে ফুটওভার ব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি সবসময় কার্যকর থাকে না।
ফুটপাতের সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লালমাটিয়া ব্লক-ই বাবরী মসজিদ রোডের ফুটপাতের ভাঙা অংশ সংস্কার করা হয় না। রাস্তায় অবৈধ দোকান বসানোয় যানজট তৈরি হয়। ফুটপাতের প্রশস্ততা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ ছাড়া লালমাটিয়ার ব্লক-ডি’তে ২৯৩ মিটার ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারের কাজ করা হয়েছে (মূল্যায়নের সময়)। ফলে রাস্তা সরু হয়ে যানজট সৃষ্টি হয়। এর জন্য রাস্তার ফেরিওয়ালা এবং অনিয়ন্ত্রিত পার্কিংও দায়ী। তাজমহল রোডে ৬৯৪ মিটার ডিভাইডার করায় যানজট কমেছে। শেরশাহ সুরি রোডে ৫১৩ মিটার রাস্তায় মালামাল রেখে ফুটপাত দখল করা হয়েছে। রিংরোড থেকে কলেজগেট পর্যন্ত রাস্তায় অযাচিত গ্যারেজ ও খাবারের দোকান থাকায় কলেজ ছুটির সময় মাঝেমধ্যে যানজট হয়।
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খিলগাঁও আনসার ক্যাম্প সড়কে রাস্তায় অল্প কিছু গর্ত আছে এবং ফুটপাতে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা হয়। খিলগাঁও আনসার ক্যাম্প থেকে বাকি সরণি পর্যন্ত রাস্তার পাশে আবর্জনার কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়। খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া সড়কে রিকশা ও ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকায় চলাচলে অসুবিধা হয়। এ ছাড়া গুলশান-১-এর ডিসিসি মার্কেটের কাছের যাত্রীছাউনিটি অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে।
আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রকল্প সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ প্রকল্পের কোনো এক্সিট প্ল্যান ছিল না। ফলে বাস্তবায়ন-পরবর্তী সময়ে কীভাবে এর ব্যবস্থাপনা করা হবে, সেটা নিয়ে কেউ ভাবেনি। তাই এ অবস্থা হয়েছে। তবে এখনকার নতুন প্রকল্পগুলোয় এক্সিট প্ল্যানের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, এখন যে অবস্থা, এতে আমরা সুপারিশ দিই মন্ত্রণালয়গুলো ব্যবস্থা নেয় কি না, সেটি জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে একটি ‘ন্যাশনাল ইভ্যালুয়েশন পলিসি’ তৈরি করে উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হয়েছে মাসখানেক আগে। সেটি অনুমোদন পেলে এর আওতায় ইভ্যালুয়েশন আইন ও বিধিমালা করা হবে। তাহলে আমরা যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অপচয়ের তথ্য তুলে আনব, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়বে।