ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ চীন বাদে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে তিন মাসের জন্য স্থগিত করায় আপাতত মন্দার আশঙ্কা অথবা বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের মহারণ থেকে মুক্ত হয়েছে। তবু ট্রাম্পের বিভিন্ন সহায়তা হ্রাসের সিদ্ধান্ত বিশ্বকে একটি নিশ্চিত বহুমুখী সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে প্রথমেই আসবে খাদ্য সংকট। এছাড়াও খাদ্যের মতো আরও কিছু মানবিক বিষয় বাধাগ্রস্ত হবে। এটা তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন দেখা গেল মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে ভূমিকম্পে অন্যান্য দেশ দ্রুত সাহায্য পাঠালেও যুক্তরাষ্ট্রের দেখা মেলেনি। গত কয়েক দশক থেকে পৃথিবী একটি চেইনে এগিয়ে চলেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভরতা এতটাই বেশি যে, হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিগত প্রেসিডেন্টরাও প্রায় একই ধরনের নীতি অনুসরণ করেছেন। যেমন- ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে শুরু হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং ইউক্রেনকে আর্থিক এবং সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। জো বাইডেন ইউক্রেনকে যুদ্ধে ভালোভাবেই ধরে রেখেছিলেন। তবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইউক্রেনকে সাহায্য করার বদলে আগের সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং বিনিময়ে বিভিন্ন শর্ত দেন। এবং যুদ্ধ বন্ধে বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইউক্রেনের রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অসম্ভব। ইরানকে পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরিয়ে এনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকতে এখন রীতিমতো হুঙ্কার দিচ্ছেন ট্রাম্প। যদি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা ফলপ্রসূ না হয় (এর আগেও একাধিকবার আলোচনা হলেও ফলপ্রসূ হয়নি) তাহলে এবার সামরিক অভিযানের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে বিশ্বকে আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে এবং নিশ্চিতভাবে সংকটে পড়তে হবে। বাণিজ্যযুদ্ধ আপাতত চীনের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকছে কিন্তু বিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্যয়ের যে কাটছাঁট করছে সেখানেই বিশ্ব বহুমুখী সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো ক্ষুধা। পৃথিবীতে ক্ষুধা একটি বড় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বহাল থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীতে প্রতিদিন বহু মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।
যেসব সিদ্ধান্ত ট্রাম্প নিচ্ছেন সেসব নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকে ভোগাবে এবং দেশগুলোকে বিকল্প পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে। ইউএসএআইডির ৮৩ তহবিল বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর কারণে বিশ্ব তীব্র খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। কারণ এসব তহবিল থেকেই জরুরি ভিত্তিতে দরিদ্র এবং ক্ষুধাপ্রবণ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করা হতো। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, তহবিল সংকটের কারণে সোমালিয়ায় তাদের সাহায্যের পরিমাণ কমানো হয়েছে। গত মাসে সংস্থাটি জানিয়েছে খরা, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও সংঘাতের কারণে দেশটিতে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগতে পারে। অপুষ্টি ও অনাহারের মুখে অনেক মানুষ মারা যাবে বলেই সতর্ক করেছেন তারা। বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ এমন অবস্থায় রয়েছে যারা সামান্য ধাক্কায় চরম দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে।’ এফএও-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী ২৮ কোটি ১১ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে ১ কোটির বেশি গুরুতর অবস্থায় রয়েছে।
ওডিআই গ্লোবাল ওয়াশিংটনের পরিচালক এলিজাবেথ ক্যাম্পবেল বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সহায়তাকারী দেশ। এখন এই সহায়তা কমানোর ফলে অপুষ্টি, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে।’ পৃথিবী জুড়েই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিপরীতে সাহায্যকারী ধনী দেশের সংখ্যা কমছে। এ নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে ডয়েচে ভেলেতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কমছে ধনী দেশগুলোর সাহায্যের পরিমাণ। জাতিসংঘ জানিয়েছে, তারা যে অর্থ জোগাড় করতে পারবে, তাতে ২০২৫ সালে ৩০ কোটি ৭০ লাখ অভুক্ত মানুষের মধ্যে ১১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানো যাবে না। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মানবিক সাহায্যের জন্য ৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা তুলতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ শতাংশ অর্থ তুলতে পেরেছে। জাতিসংঘকে যেসব দেশ প্রচুর অর্থ সহায়তা দেয়, তার মধ্যে জার্মানি অন্যতম। কিন্তু ২০২৩-এর তুলনায় ২০২৪ সালে তারা ৫০ কোটি ডলার কম দিয়েছে। তাদের মন্ত্রিসভার সুপারিশ, ২০২৫ সালে ১০০ কোটি ডলার সাহায্য কম দেওয়া হবে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় এই তালিকায় যুক্তরাজ্যও আছে। এখানেই সমস্যার শেষ নয়, সমস্যা আরও আছে। সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত সংক্রামক রোগের বিস্তারপ্রবণ এলাকায় তা হ্রাসে কাজ করা বাধাগ্রস্ত হবে। এতে সেই রোগের বিস্তার ঠেকানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধে জাতিসংঘকে তহবিল দেয় ইউএসএআইডি। এই তহবিল আর আসছে না। যুক্তরাষ্ট্র তহবিল কাটছাঁটে বিপাকে পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটিতে আগামী এক দশকে এইচআইভি আক্রান্ত ৫ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কম্বোডিয়ায় টিবি ও এইডস প্রতিরোধে যারা কাজ করতেন, তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে কতটুকু কর্তৃত্ববাদী করে তুলবে সেটা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ। কিছু সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা একলা চলো নীতিতে অগ্রসর হতে চাচ্ছে। এতে বিশ্বপরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে পারে।
বিশ্ব ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরশীল হয়েছে। এখনো যদি যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হবে এতে সন্দেহ নেই। তবে এক সময় আবার সব স্বাভাবিক হবে। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি দেশ প্রতিটি দেশের সঙ্গে সংযুক্ত। কেউ চাইলেই কাউকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা বন্ধ করলেও এক সময় বিশ্ব ফের ঘুরে দাঁড়াবে। তবে মানবিক বিশ্ব গড়তে যে সাময়িক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, এ কথা নিশ্চিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট