অপার সম্ভাবনা ঘিরে রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ। যাকে আমরা বলি ‘নীল অর্থনীতি’। বেলজিয়ামের অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে এই নীল অর্থনীতির ধারণা জন্ম দিয়েছিলেন। ‘নীল অর্থনীতি’ হচ্ছে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ও এর তলদেশের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ কাজে লাগানোর অর্থনীতি হচ্ছে এটি। সমুদ্র থেকে আরোহণকৃত যেকোনো সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলে, তা নীল অর্থনীতিতে পড়বে। জাতিসংঘ ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতিকে মহাসাগর, সমুদ্র ও উপকূলীয় সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের একটি পরিসর হিসেবে উল্লেখ করে। সুনীল অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি এবং সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত একটি বিশাল জলরাশি যা দেশের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যদি এই বঙ্গোপসাগর না থাকত, তবে বাংলাদেশের জন্য তা হতো এক গভীর সংকটের কারণ। অর্থনৈতিকভাবে, বাংলাদেশ তার অধিকাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য করে সমুদ্রপথে। চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা বন্দর থেকে দেশের প্রধান রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বঙ্গোপসাগর না থাকলে এসব বন্দর থাকত না। ফলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতো। একই সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ ধরা, লবণ উৎপাদন ও অফশোর গ্যাস উত্তোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোও হারিয়ে যেত। এর ফলে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ত। একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রে পরিণত হতো বঙ্গোপসাগর না থাকলে। তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত, যা স্বাধীনতার জন্য হুমকি হতে পারত। এর ফলে আমাদের প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত গুরুত্ব হারিয়ে যেত।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে টহল দিয়ে দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা করছে। যদি সাগর না থাকত, তবে এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ত এবং সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চল দাবি করতে পারত না। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেও ব্যাপক ক্ষতি হতো। সুন্দরবনের দক্ষিণাংশ, উপকূলীয় চরাঞ্চল, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকত। পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ, কোরাল রিফ, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিনের মতো প্রাণীর অস্তিত্বও থাকত না। সবচেয়ে বড় কথা, পর্যটনশিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। সামুদ্রিক গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করে বঙ্গোপসাগরের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত ব্লু ইকোনমি ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই ব্যবহারে সহায়তা করবে। সার্বিকভাবে, বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকোনমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসইয়ে অপার সম্ভাবনা বহন করে। তবে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই ব্যবহারে সুপরিকল্পিত নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি।
বঙ্গোপসাগর শুধু একটি জলাধার নয়, বরং এটি একটি সংযোগস্থল, যেখানে সমুদ্রবাণিজ্য, সম্পদ আহরণ এবং কৌশলগত আধিপত্যের প্রতিযোগিতা একসঙ্গে প্রবাহিত হয়। বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকোনমি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, যা সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখে। বাংলাদেশের মোট প্রাণিজ প্রোটিনের ৫২ শতাংশ মৎস্য থেকে আসে, যেখানে সামুদ্রিক মৎস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৫ শতাংশ অবদান রাখে। বঙ্গোপসাগরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অব্যবহৃত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে, যা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কক্সবাজারের মতো সমুদ্রসৈকত এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেশের পর্যটনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে সহায়তা করে। দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি সমুদ্রপথে পরিচালিত হয়, যেখানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর প্রধান ভূমিকা পালন করছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপ এলাকায় নৌ-ভিত্তিক পর্যটনের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।
বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক শিপিং রুট, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার জাহাজ চলাচল করে এবং বিশ্বব্যাপী পণ্য ও জ্বালানির অর্ধেকেরও বেশি এই পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক গুরুত্বের মতো রয়েছে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব। এটি চীন ও ভারতের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রস্থল। চীন ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ নীতির মাধ্যমে বন্দরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ভারত অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মাধ্যমে নিজ অবস্থান শক্তিশালী করছে। বঙ্গোপসাগর দিয়ে বছরে লক্ষাধিক জাহাজ চলাচল করে, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যের একটি বড় অংশ পরিবাহিত হয়। বঙ্গোপসাগর চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ অংশ। চীন বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে জ্বালানি ও পণ্য আমদানি করে। ভারতের পূর্ব উপকূলীয় রাজ্যগুলো বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। এটি ভারতের নৌবাহিনীর জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
নেপাল একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, যার কোনো নিজস্ব সমুদ্রবন্দর নেই। বাংলাদেশ দেশটিকে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। বঙ্গোপসাগর নেপালের আমদানি-রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করে নেপাল। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে নৌ পরিবহন চুক্তি কার্যকর হওয়ায় নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটননির্ভর অর্থনীতি মালদ্বীপের। খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগ প্রয়োজন যেখানে বঙ্গোপসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। মালাক্কা প্রণালি এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক ও সামুদ্রিক সম্পর্ক রয়েছে। এটি ভারত মহাসাগরের অংশ হিসেবে আন্দামানকে দক্ষিণ চীন সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। মালাক্কা প্রণালি হলো বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম বাণিজ্যিক নৌপথ, যা বঙ্গোপসাগর থেকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। যেমন : চীন, জাপান, কোরিয়া যাতায়াতের প্রধান রুট। বঙ্গোপসাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশ করে। অর্থাৎ এটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। প্রণালি ও বঙ্গোপসাগর মিলে একটি কৌশলগত সমুদ্র অঞ্চল গঠন করে, যেটি এশিয়ার অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে, সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও দুর্যোগ সহায়তা প্রচেষ্টায় একমত হয়েছে। আমাদের দেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের সামরিক গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি জিওস্ট্র্যাটেজিক সুবিধা, কারণ এ সমুদ্র দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সামরিক জাহাজ চলাচল হয়। বাংলাদেশের প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে, যা পাহারা দেওয়া ও রক্ষা করা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, যেমন ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। সামরিক বাহিনী মানবিক সহায়তা দিতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে।বিশ্বের ৬৪ শতাংশ তেল বাণিজ্য এই জলপথের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম বন্দর হলো এই বিশাল অর্থনৈতিক এলাকার প্রবেশ মুখ। চট্টগ্রাম কিংবা মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা সম্ভব হলে, চট্টগ্রাম হতে পারে এই বিশাল বাণিজ্য পথের প্রবেশ মুখ। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক