সারা বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে বায়ুদূষণ। এই দূষণের ফলে আমাদের শরীর ক্রমে আক্রান্ত হচ্ছে নানা ব্যাধিতে। প্রায়ই রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার ওপরে থাকছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, বিশ্বে বায়ুদূষণে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। তবে রাজধানী হিসেবে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। বায়ুদূষণ কেন হচ্ছে, কারা দায়ী এসব নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণা হয়েছে অনেক। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। যে দেশের অধিকাংশ মানুষের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’, তারা কীভাবে নিজ থেকে দূষণ বিষয়ে সচেতন হবেন? যুগ যুগ ধরে সরকার বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি।
বৈশি^ক বায়ুমান পর্যবেক্ষক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা প্রায়ই পৃথিবীর দূষিততম নগরীগুলোর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকে। পরিবেশবিদরা বলছেন, অন্য দেশগুলো বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে যেখানে পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে, সেখানে ঢাকা পুরোপুরি ব্যর্থ। দূষণের সব থেকে বড় উৎস ঢাকার বর্জ্য। অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে শহরের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দূষণ দূর করতে কখন, কোন প্রতিষ্ঠান, কীভাবে, কার মাধ্যমে কাজ করবে এটা কেউ জানে না। এ বিষয়ে দেশ রূপান্তরে শনিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের প্রভাবে বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু লাখের বেশি। ফলে অনুমান করা যায়, নির্মল বায়ুর অভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে আয়ু কমছে এই শহরের মানুষের। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত শ্বাস নেওয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় বায়ুদূষণের কারণে। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় বায়ুদূষণ রোধে বিগত সরকার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নয়ছয় হয় নানাভাবে। ফলাফল ‘জীবন বাঁচানোর’ প্রকল্প অকেজো, বায়ুদূষণ আগের মতোই। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো রয়েছেই। দুদকের তথ্যমতে, নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) নামে ২০১৯ সালে শেষ হওয়া প্রকল্পটি ছিল একটি আমব্রেলা প্রকল্পের অংশ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় মূল প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৪৪৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫১ কোটি ৮৪ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৩৯৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকল্পে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রকল্পটি যে উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, এর অনেক কিছুই বাস্তবে কাজে লাগেনি। বাস্তবায়নের চার বছর পর প্রস্তাব মূল্যায়ন করে এসব তথ্য উদঘাটন করে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রকল্পের বেশিরভাগ আউটপুট মুখ থুবড়ে পড়েছে। নেই কোনো মনিটরিং ও জবাবদিহি। এর সঙ্গে জড়িতদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গবেষকরা বলেছেন, রাসায়নিক বিভিন্ন দূষণের কারণে অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াল বায়ুদূষণ বাড়ছে রাজধানীতে। এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, যা উন্মুক্তভাবে বর্জ্য ফেলে রাখার কারণে ছড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালির সঙ্গে মানুষের গলায় ঢুকে ইনফেকশন তৈরি করছে। এ কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। একই সঙ্গে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ হ্রাসে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে এবং শিল্পকারখানার বায়ুদূষণ হ্রাসে এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে বায়ুদূষণ বিষয়ে সচেতন করা না হলে একসময় গুনতে হবে বড় ধরনের মাশুল। কী অদ্ভুত দায়িত্বহীন মনোবৈকল্য! মানবিকতার এমন নিদারুণ লোভাতুর পরাজয় খুব কম দেশে দেখা যায়।