বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

হজ ঐক্য ও সাম্যের প্রতীক

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৮ এএম

হজ উপলক্ষে এ বছর সৌদি আরবে সমবেত হবেন ২০ লাখের অধিক মুসলমান। মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় জমায়েত এটি। বাংলাদেশ থেকে এ বছর পবিত্র হজের ফ্লাইট শুরু হবে ২৯ এপ্রিল। হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৮৭ হাজার ১০০ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে যাবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকছেন ৫ হাজার ২০০ জন, আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮১ হাজার ৯০০ জন। হিজরি ১৪৪৬ সনের ৯ জিলহজ, অর্থাৎ চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৪ বা ৫ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে।

হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ভ্রমণের উদ্দেশে বের হওয়া, যেকোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা। পরিভাষায় হজ বলা হয়, নির্দিষ্ট দিনে নিয়তসহ ইহরাম অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা। হজ ইসলাম পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচটি জিনিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এক. আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বান্দা ও রাসুল, এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া। দুই. নামাজ আদায় করা। তিন. জাকাত দেওয়া। চার. হজ করা। পাঁচ. রমজান মাসের রোজা রাখা। হজ হলো ঐক্য ও সাম্যেরে প্রতীক। প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মুসলমান এক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে মক্কায় আগমন করেন, একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বায়তুল্লাহ জিয়ারত করেন। এখানে ধনী-দরিদ্রের কোনো ভেদাভেদ নেই। ভেদাভেদ নেই সাদা ও কালোর। সবার একই উদ্দেশ্য। সবার মুখে একই ধ্বনি, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ অর্থ : আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার কোনো শরিক নেই, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নেয়ামত ও সাম্রাজ্য আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন কাবাঘর। কাবাঘরটি হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্র্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজ পালনের। আল্লাহতায়ালা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাকে হজের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইব্রাহিম (আ.) তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব আহকাম। এরপর আল্লাহর নির্দেশ এলো হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেওয়ার।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে, সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শোনে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তখন মাকামে ইব্রাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।’

কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে আরোহণ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, ‘ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই আহ্বান এই জগতের সীমা অতিক্রম করে রুহানি জগতে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং লাব্বাইক বলে যেসব রুহ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল আল্লাহ চান তো কেয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে!’

এ হজ দ্বারা স্থাপিত হলো বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের সুন্দরতম এক দৃশ্য। হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইব্রাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যারা অস্বীকার করবে (তাদের স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭) আবার একই বাণী ধ্বনিত হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষায়। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ করো।’ (সহিহ মুসলিম) নবীজি (সা.) হজের ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ ও কবুল একটি হজ পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। বেহেশত ছাড়া আর কোনো কিছুই এর প্রতিদান হতে পারে না।’ আরেক বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে হজ করবে, হজ পালনকালে কোনো ধরনের গুনাহের কাজে লিপ্ত না হবে, সে (হজ শেষে) সদ্যোজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ অবস্থায় ঘরে প্রত্যাবর্তন করবে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত