‘ভালো থেকো’ শব্দগুলো উচ্চারণ করলেই কেমন একটা ফাঁকা অনুভব হয়। যেন কিছু রেখে যেতে চাই, অথচ পুরোটা বলা যায় না। বিদায় মানেই কি শূন্যতা? নাকি এটা নতুন কিছু শুরুর দরজা? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিদায় বলার সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
আমরা প্রতিনিয়ত নানা রকমের বিদায় বলি সকালবেলা কর্মস্থলে বের হওয়া, কারও সঙ্গে দেখা শেষে হাত নাড়ানো, এমনকি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কারও মুখের দিকে তাকিয়ে শেষবার চোখের ভাষায় কিছু বলে যাওয়া। এসব মুহূর্ত আমাদের অভ্যস্ত জীবনধারার অংশ হলেও, সংস্কৃতিভেদে বিদায় বলার ধরন, গুরুত্ব এবং অভিব্যক্তির পার্থক্য আমাদের চিন্তাভাবনার দৃষ্টিকোণ বদলে দিতে পারে।
শব্দে মমতা, অনিশ্চয়তা, আশ্বাস একটি সমাজ কীভাবে বিদায় বলে, তা বোঝার জন্য তাদের ভাষার দিকে তাকানো জরুরি। ভাষার গঠন, শব্দ চয়ন এবং উচ্চারণের ভঙ্গি আমাদের ভাবনার অভ্যন্তরীণ স্তরকে প্রকাশ করে।
বাংলা ভাষায় ‘ভালো থেকো’ বা ‘আবার দেখা হবে’ যেন আশার একটি ছোট্ট বাতিঘর। মৃত্যু পর্যন্তও আমরা বলে ফেলি ‘ভালো থাকুক।’ মৃত্যুকেও তাই এখানে চূড়ান্ত বলে মনে হয় না। বরং থাকে একটা স্মৃতির অভিজ্ঞান, একটা প্রার্থনা।
জাপানি ভাষায় ‘সায়োনারা’ শব্দটি বেশ আনুষ্ঠানিক ও দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছেদের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে তারা সাধারণত বলেন, ‘জানে’ বা ‘মাতানে’-এর মানে হলো ‘আবার দেখা হবে’। জাপানে হাত মেলানোর বদলে বিদায় বলা হয় এক বা একাধিক নম্র, নীরব মাথা নুইয়ে। এটি ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রকাশের উপায়, এটি একটি দৃষ্টিনন্দন নমো (নড়)ি । নমো যত গভীর, তত বেশি সম্মান। এই শারীরিক নীরব ভাষার মধ্যে থাকে বিনয়, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ববোধ। জাপানি বিদায় যেন একটি শব্দহীন কবিতা।
হিন্দিতে ‘আলবিদা’ বলা হয় মৃত্যু বা চূড়ান্ত বিচ্ছেদের সময়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয় ‘ফির মিলেঙ্গে’ যার মধ্যে থাকে পুনর্মিলনের আশ্বাস।
ইতালিয়ানরা বলেন, ‘Arrivederci’ মানে আবার দেখা হবে।’ ‘Addio’ হলো চূড়ান্ত বিদায়, কিন্তু তা ব্যবহৃত হয় অনেক কম। শব্দচয়নে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে নরম থাকে।
ইউরোপীয় ও আফ্রিকান বহু ভাষায় বিদায় বলার সঙ্গে শরীরী ভঙ্গিমাও জড়িত। কেউ করমর্দন করেন, কেউ কোলাকুলি, কেউ আবার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই বিদায় জানান।
আচার ও রীতিনীতির মধ্যে বিদায়ের দর্শন শুধু ভাষা নয়, বিদায়ের আচার-অনুষ্ঠানগুলো আমাদের মূল্যবোধকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
আইরিশ সংস্কৃতিতে ‘wake’ এক অনন্য রীতি। প্রিয়জনের মৃত্যুর পর তাকে ঘরে রাখা হয়, অতিথিরা আসেন, গল্প বলেন, গান করেন, কখনো হাল্কা মজা করেও মৃতের স্মৃতি রোমন্থন করেন। দুঃখকে এক ধরনের সামাজিক স্মরণে পরিণত করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার টোরাজা জনগোষ্ঠী মৃতদেহকে মাসের পর মাস বাড়িতে রেখে দেন যতক্ষণ না পরিবার ও সমাজ প্রস্তুত হয় শেষ বিদায়ের জন্য। ততদিন মৃত আত্মীয় ‘মকুলা’ হিসেবে থাকেন একজন জীবিত সদস্যের মতো। তারা বিশ্বাস করেন, বিদায় একটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন হওয়া প্রক্রিয়া।
মেক্সিকোর ‘Día de los Muertos’ বা ‘মৃতদের দিন’ একটি উৎসব, যেখানে পরিবারের সদস্যরা মৃত প্রিয়জনদের ছবি, প্রিয় খাবার ও উপহার রেখে তাদের স্মরণ করেন। এটি বিদায় নয়, বরং পুনঃসংযোগের এক দিন।
পাপুয়া নিউগিনির নীরব বিদায়। সেখানকার অনেক জনগোষ্ঠী বিদায় জানায় একেবারে নীরব থেকে। সেখানে বিশ্বাস করা হয়, বিদায় বলার মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তাই তারা বিদায়কে এড়িয়ে চলে চোখাচখি বা স্পর্শই শেষ ভাষা। এই সংস্কৃতি যেন বলতে চায়, সম্পর্ককে শেষ না করেও দূরে যাওয়া যায়।
হাওয়াই-এর ‘Aloha| Aloha’ শব্দটি একই সঙ্গে হ্যালো এবং বিদায় তবে শুধু কথার অর্থে নয়, এটি একটা জীবনদর্শন। এর মধ্যে ভালোবাসা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও আত্মিক সংযোগের মিশ্রণ থাকে। যেন বলছে, আমি তোমাকে দেখি, বুঝি, ভালোবাসি তোমার অনুপস্থিতিতেও।
বাংলাদেশে কেউ মারা গেলে জানাজা, কবর দেওয়া, মিলাদ সবকিছু শেষ হলে কিছু আত্মীয় দীর্ঘদিন দোয়া চালিয়ে যান। কেউ কেউ প্রতি মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ দেন। এতে বিদায় হয় চলমান, স্মৃতিতে সক্রিয়। চোখের জল, নীরবতা আর দীর্ঘশ্বাসের ভেতরও থাকে বিদায়।
কেন বিদায় বলা দরকার
বিদায় একটি ছোট্ট শব্দ, কিন্তু তার প্রভাব অনেক গভীর। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা নানা সময়ে নানাজনকে ‘বিদায়’ বলি বন্ধুদের স্কুল শেষে, সহকর্মীদের কাজ শেষে, কিংবা প্রিয়জনকে জীবনের কোনো পর্যায়ে বিদায় জানাতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘বিদায় বলা’ আসলে কতটা জরুরি? এটি কি নিছক সামাজিক শিষ্টাচার, নাকি এর পেছনে আছে গভীর মানসিক প্রক্রিয়া?
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি : ‘ক্লোজার’-এর গুরুত্ব
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিদায় বলা মানে শুধু ‘বাই’ বলে চলে যাওয়া নয় এটা এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি ও সম্পর্কের এক ধাপে পূর্ণতা আনার প্রক্রিয়া। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ‘বিদায় বলা মানে হচ্ছে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে সংযোগ স্থাপন করা, যা আমাদের মনের ভার লাঘব করে এবং নতুন কিছুর জন্য জায়গা তৈরি করে।’ এর মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি আছে ‘closure’ তত্ত্বে। কোনো সম্পর্ক, অধ্যায় অথবা অভিজ্ঞতার সমাপ্তিতে আমরা যদি অর্থপূর্ণভাবে বিদায় জানাতে পারি, তবে সেটি আমাদের মনে সেই ঘটনার প্রতি এক প্রকার শান্তিও গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। না হলে, অনেকেই ‘অপূর্ণতা’র অনুভূতি বয়ে বেড়ান যা পরবর্তী সময় দুঃখ, অপরাধবোধ বা মানসিক চাপের রূপ নিতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বিদায় বলা শেখানো উচিত। এটি তাদের মধ্যে সহানুভূতি, সংযোগ এবং সংবেদনশীলতা গড়ে তোলে। হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে চলে যাওয়া শিশুদের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে পারে।
দুঃখ নয়, স্বীকৃতির ভাষা
বিদায় মানেই যে দুঃখ, তা নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে বিদায় একটি সম্মান জানানোর উপায়। যেমন প্রিয় কোনো সহকর্মীর বিদায় উপলক্ষে দেওয়া বিদায় বাণী বা অনুষ্ঠানে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই, স্মৃতিচারণ করি যা সম্পর্ককে আরও অর্থবহ করে তোলে। বর্তমানে অনেক সম্পর্কই ভার্চুয়াল সোশ্যাল মিডিয়া, ইমেইল বা মেসেজিং অ্যাপে গড়ে ওঠা সম্পর্কের বিদায়গুলো অনেক সময় হঠাৎ ও আবেগবর্জিত হয়। এর ফলে অনেকেই ‘hosting’ বা হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার মতো অভিজ্ঞতার শিকার হন, যা বিশেষ করে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিদায় বলা শিখলে ব্যক্তির মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা তৈরি হয়। সামাজিকভাবে এটি সম্পর্কের গুণমান বজায় রাখে, ভুল
বোঝাবুঝি কমায় এবং সম্মানপূর্ণ সহাবস্থানকে উৎসাহিত করে।
বিদায় মানে স্মৃতি রেখে যাওয়া
সব বিদায়েই কিছু রেখে যাওয়া যায় একটা চিঠি, একটা ছবি, একটা প্রিয় খাবারের গন্ধ। একজন মানুষ চলে গেলেও তার ব্যবহৃত চেয়ারটা, কাপটা, রুমালের ভাঁজ সবই হয়ে ওঠে শেষ কথা।
কেউ প্রবাসে চলে যাওয়ার আগে বোনকে তার প্রিয় বইটা দিয়ে যান। কেউ ফোন রেখে দেওয়ার আগে বলেন, ‘খেয়ো ঠিকমতো।’ এসব ছোট ছোট বিদায়ই আসলে বড় আবেগ।
পৃথিবী ছেড়ে বিদায় মহাশূন্যে...
সব সংস্কৃতি, সব ভাষা, সব মানুষ শেষমেশ একটাই কথা বলে : ‘ভালো থেকো।’
এমনকি, আমরা এই কথা পৃথিবীর বাইরেও পাঠিয়ে দিয়েছি। ১৯৭৭ সালে, ভয়েজার ১ ও ভয়েজার ২ মহাকাশযান দুটি পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় চিরকালের মতো। তারা এখনো ছুটে চলেছে মহাকাশের গভীরে মানবজাতির পক্ষ থেকে বহুদূরের অজানা কোনো প্রাণীকে সম্ভাব্য প্রথম ‘হ্যালো’ জানাতে।
তাদের শরীরে আছে একটি সোনালি ডিস্ক দ্য গোল্ডেন রেকর্ড, যার ভেতরে রয়েছে ৫৫টি ভাষায় শুভেচ্ছা বার্তা, বাঙালির ‘রাগা’সহ বিশ^সংগীত, পৃথিবীর শব্দ, শিশুর কান্না, ট্রেনের হুইসেল, বৃষ্টির আওয়াজ এবং মানুষের আলত কণ্ঠে বলা ‘Goodbye’।
ভাবুন তো আমরা এমন এক বিদায় বলেছি, যার উত্তর জানার জন্য আমাদের হাজার বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমরা সেই বার্তাটিতে রেখে দিয়েছি আশা, কৌতূহল, সৌহার্দ্য আর একটি বিশাল প্রশ্ন ‘তুমি কে?’
এই এক আশ্চর্য বিদায় যা একেবারে একমুখী, অথচ তাতে লুকিয়ে আছে সম্পর্ক তৈরির চূড়ান্ত আকাক্সক্ষা।
ভয়েজারের সোনালি ডিস্কে যে কথাগুলো লেখা, তা মূলত একটি আন্তঃনাক্ষত্রিক উপহার। যদি কোনো এক দিন, কোনো এক বুদ্ধিমান প্রাণী সেই ডিস্ক খোলে, তবে তারা বুঝবে এই ছোট্ট নীল গ্রহের মানুষরা চলে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, ‘তোমাকে জানাতে চাই আমরা আছি, আমরা শুনতে চাই তোমার কথা এবং হ্যাঁ তোমাকে স্বাগত।’ সব বিদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ, সবচেয়ে নীরব আর সবচেয়ে নিশ্চিত একটি বিদায় অপেক্ষা করছে আমাদের সবার জন্য, আমাদের গ্রহের জন্য, এমনকি পুরো সৌরজগতের জন্যও।
পৃথিবী আর মানুষ তো একদিন প্রস্থান করবেই, কিন্তু সূর্যও চিরকাল থাকবে না।
আজ থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পরে, আমাদের সূর্য তার শেষ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তখন সে ফুলে-ফেঁপে উঠবে, পরিণত হবে এক বিশাল লাল দৈত্যে (Red Giant) । সেই সময়ে সে গ্রাস করে ফেলবে বুধ, শুক্র, এমনকি আমাদের পৃথিবীকেও সবকিছু পুড়ে যাবে চরম উত্তাপে।
এই প্রলয়ংকারী দৃশ্যের শেষে, সূর্য তার সমস্ত শক্তি হারাবে এবং ধীরে ধীরে পরিণত হবে এক ছোট্ট সাদা বামনে (White Dwarf) একটি নিঃশব্দ, ম্লান জ্যোতিষ্ক, যা শুধু অতীতের এক গৌরবময় ইতিহাস বহন করে চলবে।
কেউ তখন বেঁচে থাকবে কিনা জানি না।
কিন্তু যদি কোনো ভবিষ্যৎ সভ্যতা আমাদের ইতিহাসের টুকরো খুঁজে পায়, তাহলে তারা দেখবে আমরা বিদায় বলেছিলাম ভাষায়, সংগীতে, রীতিতে, মহাকাশযানে।
তারা বুঝবে, এই সৌরজগতের ক্ষণস্থায়ী প্রাণীরা একসময় খুব যতœ করে বলেছিল, ‘তোমায় বিদায়, প্রিয় সূর্য। ধন্যবাদ আলো দেওয়ার জন্য।’
ভালো থেকো, দেখা হবে।
মানুষ সামাজিক জীব। সম্পর্ক আমাদের বেঁধে রাখে, আবার ছাড়াও দেয়। আর সেই ছাড়ার মুহূর্তগুলোতেই আমরা বুঝে যাই কতটা গভীর ছিল সংযোগটা। একটা সুন্দর বিদায় মানে একটা সুন্দর সম্পর্কের শেষ ধাপ।
আর যদি দেখা না-ও হয়?
তবু বলি, ভালো থেকো।