বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সে সময়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৮ এএম

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে কেমন ছিল ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক? কবি, সমালোচক, প্রাবন্ধিক কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ছিলেন এ বিশ^বিদ্যালয়ের বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শিক্ষার্থী। তিনি নিজে ছাত্রজীবনে কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ছিলেন নতুন যুগের সাহিত্যরুচির অন্যতম কা-ারি। তা নিয়ে তার শিক্ষকদের সঙ্গে যে মতাদর্শিক পাঞ্জা লড়েছিলেন তার মধুর বিবরণ তুলেছেন তার ‘সংস্কৃতিকেন্দ্র : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নিবন্ধে। তবে আনন্দের বিষয় হলো, শিক্ষকদের সঙ্গে তার যে লড়াই হয়েছিল সেটি মোটেও তিক্ত রূপ লাভ করেনি। বরং তা ছাত্র-শিক্ষক সৌহার্দ্য ও সংস্কৃতিমনা মানুষের সুরুচির সাক্ষ্যই বহন করে।

শিক্ষকদের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই তিনি উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই মানুষটি ছিলেন সাহিত্যরসিক ও কাব্যরসিক। তিনি তাকে সাহিত্যসভায় সভাপতি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সভাপতির বক্তৃতা শুনে তার বিস্ময় বাড়ল বৈ কমল না। তখনকার একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক শুধু বিজ্ঞানের বিষয় নিয়েই পড়ে থাকতেন না। জ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও আগ্রহ রাখতেন।

কবি মোহিতলাল মজুমদার ছিলেন কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের সরাসরি শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে চমৎকার বক্তৃতা দেওয়া এই মানুষটি ভদ্রভাষায় তীব্রভাবে আক্রমণ করতেন তখনকার নব্য কাব্যসাধকদের, যারা পরবর্তী সময়ে আধুনিক কবি হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। তারুণ্যের ধর্ম অনুযায়ী কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ছিলেন এই আধুনিক কবি অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুদের পথযাত্রী। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকের একটি সাহিত্য সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করে তিনি লিখেছেন মাসিক ‘শান্তি’ পত্রিকার একটি সংখ্যাতে। লেখাটি পড়ে মোহিতলাল ক্রুদ্ধ হন, কিন্তু কখনো ক্লাসে বা ক্লাসের বাইরে কটু কথা বলেননি বা সমালোচনা পড়ে পাল্টা ব্যক্তি আক্রমণ করেননি। তার সমালোচনা ছিল তত্ত্বীয়, আধুনিক কবিদের আদর্শ ও সাহিত্যরুচির বিরুদ্ধে। কিরণশঙ্কর ভয় না পেলেও তার জন্য ভয় পেয়েছিলেন কাজি আবদুল ওদুদ। তিনি একদিন তাকে ডেকে বললেন, কিরণশঙ্কর, এ কী ব্যাপার করেছ! জানো, মোহিতবাবু তোমাকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন? উত্তরে কিরণশঙ্কর বলেছিলেন, এ ধরনের সংকীর্ণতা মোহিতলালের নেই বলেই আমার বিশ্বাস, কেন না। সাহিত্য-বিচারের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ও ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন হলেও ছাত্র হিসেবে আমি তার স্নেহভাজন, তিনি কখনোই আমার ক্ষতি করবেন না।

সাহিত্যরুচির সমালোচনা করলেও কিরণশঙ্করের কাব্যশক্তির ওপর মোহিতলালের আস্থা ছিল। তিনি তার ‘গলিতনখ’ কবিতা পড়ে ডেকে প্রশংসা করেছিলেন। শুধু তাই না, বিভিন্ন সময় সাহিত্যালোচনাও করতেন। এ সময় কিরণশঙ্কর আরেকটি বয়সোচিত ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন। ঢাকা হল বার্ষিকী ‘শতদল’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব তার ওপর বর্তালে তিনি নিজের সাহিত্যরুচি মতো সম্পাদনা করে প্রকাশিত সংখ্যাটি মোহিতলালের সামনে উপস্থাপন করেন। কিন্তু রীতি ছিল, সম্পাদক উপদেষ্টাদের মতামত নিয়ে তা সম্পাদনা করবেন। মোহিতলাল ছিলেন উপদেষ্টাম-লীর সদস্য। তবে পত্রিকার সম্পাদকীয়টি পড়ে কিরণশঙ্করের ভাষাজ্ঞানে তিনি সন্তুষ্ট হন এবং ব্যাপারটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে রাজি হন। তখন ছাত্র-শিক্ষক মতাদর্শিক লড়াইটি যেমন ছিল ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’ তেমনি তা ছিল শিষ্টাচার দ্বারা আবৃত।

সুলতানা রাজিয়া

(শিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের ‘সংস্কৃতিকেন্দ্র : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নিবন্ধ অবলম্বনে)

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত