বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

দুনিয়া কাঁপানো ইশতেহারের কথা

আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৩৬ এএম

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, যখনই মানুষের মনের ভেতরে জমেছে ক্ষোভ, হতাশা বা মুক্তির আকুতি তখনই কেউ একজন কলম তুলে নিয়েছে। শব্দ দিয়ে নির্মাণ করেছে আগ্নেয়গিরি। কিছু লেখা হয়ে ওঠে ইশতেহার, এ নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কিছু লেখা আসে, যেগুলো কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা হয়ে ওঠে ধ্বনি, মিছিল, পতাকা, প্রতিরোধ। এসব লেখারই একটি রূপ হচ্ছে ইশতেহার। যেমনটা মার্কস ও এঙ্গেলস লিখেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে, “একটি ভূত ইউরোপকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে ‘ভূত’ শব্দটি শুধু ভূত নয়, এটি বিপ্লব বা পরিবর্তনের এক ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ, রহস্যময়, আতঙ্ক জাগানো উপস্থিতিকে বোঝায়।...” সেই ছায়া আজও অমøান। কিন্তু এ ধরনের বিপ্লবী দলিল কেবল একটি বা দুটি নয়, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন জাতির বুক থেকে উঠে এসেছে এমন কিছু লেখা, যেগুলো বদলে দিয়েছে মানুষের চিন্তা, রাজনীতি, সমাজ, এমনকি ধর্মীয় কাঠামোও। এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব এমন কয়েকটি বিপ্লবী ইশতেহারকে, যেগুলো শুধু সময়ের সাক্ষী নয়, সময়ের ঘূর্ণি তৈরিকারী।

কিন্তু কী এমন থাকে এই লেখাগুলোতে, যা হাজারো সাধারণ লেখার ভিড়ে তাদের করে তোলে অসাধারণ? কেমন করে একখণ্ড পা-ুলিপি বদলে দেয় গোটা দুনিয়ার ভুবনচিত্র?

ইশতেহার মানে শুধু আহ্বান নয়, তা এক বিবৃতি, যা জ্বালায়, জাগায়, যুদ্ধে ডাকে। যখন লেখক শব্দ দিয়ে পাঠকের অস্তিত্ব নাড়িয়ে দেন। লেখাটি পাঠকের ব্যক্তি গত অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি হয়ে উঠলে, তা আর কেবল ‘লেখা’ থাকে না, তা হয়ে ওঠে অস্ত্র।

এসব ইশতেহারে থাকে এক অভিন্ন সুর একটি স্পষ্ট, নির্ভীক দাবি : পরিবর্তন চাই। তারা সমাজের গভীরে বসে থাকা অস্বস্তিও অসমতা তুলে ধরে। তারা একযোগে প্রশ্ন তোলে এবং দিকনির্দেশও দেয়। লেখা যখন শুধু যুক্তির খেলা নয়, হৃদয়ের চিৎকার হয়ে ওঠে, তখনই তা বিপ্লবের জন্ম দেয়। বিপ্লবী লেখা আসলে একটি অভিজ্ঞতার জ্যোতির্বিজ্ঞান। যেটি পাঠকের মনে এমন কিছু সংযোগ সৃষ্টি করে, যা সে হয়তো ভেবেছে কিন্তু কখনো শব্দে ধরতে পারেনি। যখন লেখকের কণ্ঠ হয়ে ওঠে পাঠকের গোপন উচ্চারণ সেখানে জন্ম নেয় প্রতিবাদ। আর প্রতিবাদ থেকেই তো শুরু হয় বিপ্লব। এসব ইশতেহার হোক তা মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে, ফ্রান্ৎস ফাননের ‘জগতের লাঞ্ছিত’, কিংবা বেটি ফ্রিডানের ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ প্রতিটিই একটি সময়ে এসে নিছক বই ছিল না, বরং হয়ে উঠেছিল জীবন পাল্টানোর ম্যানুয়াল। কারণ এদের ভাষায় ছিল আগুন, কণ্ঠে ছিল ন্যায়ের দাবিতে গর্জন। একটি বিপ্লবী লেখা তার সময়কে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করে কে শাসন করছে, কেন করছে, কাদের বাদ দিয়ে করছে। প্রশ্ন করে কেন নারীরা নীরব? কেন কৃষকের জমি নেই? কেন কৃষ্ণাঙ্গের রাস্তায় হাঁটাও ভয়ানক? এরা সমাজের অসন্তোষকে ভাষা দেয়, যা এতদিন চুপ ছিল। তবে শুধু প্রশ্ন করলেই বিপ্লব হয় না। এসব লেখা দিকনির্দেশও দেয় কীভাবে জাগতে হবে, কীভাবে গড়তে হবে একটি নতুন পৃথিবী। এই দিকনির্দেশ কোনো একমাত্রিক আদর্শ নয় এ এক বহুমাত্রিক অস্তিত্বচর্চা, যেখানে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং জীবনবোধ হাত ধরে চলে।

এই লেখাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় কলমই কখনো কখনো বন্দুকের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

কমিউনিস্ট ইশতেহার

‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও!’ ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস যখন কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার লেখেন, তখনো পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ চলছে। কিন্তু এই লেখায় উঠে এলো শ্রমজীবী মানুষের শোষণের কাহিনি, শ্রেণিসংঘাতের বাস্তবতা এবং এক নতুন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন যেখানে উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে জনগণের হাতে। ‘শোষকের শৃঙ্খল ভাঙো’ এই আহ্বান শুনে বিশ্ব জুড়ে গড়ে উঠল শ্রমিক আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, এমনকি রাষ্ট্রের পতন। ইশতেহারটি আজও শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে। এর ভাষা তীব্র, সরল এবং অবিস্মরণীয় একটি লেখা কেমন করে একটি মতাদর্শকে আন্দোলনে পরিণত করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

নারীবাদের বিবৃতি

বেটি ফ্রিডান যখন ১৯৬৩ সালে দ্য ফেমিনিন মিস্টিক লেখেন, তখন নারীজাগরণ একটি দমিত, চাপা লড়াই। তিনি প্রশ্ন তুললেন গৃহিণীর আদর্শ নিয়ে, সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নারীত্বের ধারণা নিয়ে। ‘নারী কি কেবল একজন স্ত্রীর ভূমিকায় সীমাবদ্ধ?’ এই এক প্রশ্নে ফুঁসে উঠল আমেরিকার মধ্যবিত্ত নারীসমাজ। এই বই জন্ম দিল দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের। বদলে দিল কর্মসংস্থান, শিক্ষাব্যবস্থা ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের পরিপার্শ্ব। একটি লেখাই কখনো কখনো হতে পারে লাখ লাখ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি।

বঞ্চিতদের কণ্ঠস্বর

ফ্রাঞ্জ ফ্যাননের লেখা ‘জগতের লাঞ্ছিত’ (১৯৬১) হলো উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মূল ইশতেহার। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা এই বই উপনিবেশিত জাতিগুলোর ক্ষোভ, বিদ্রোহ ও আত্মমর্যাদার চেতনাকে তুলে ধরেছে। ফ্যানন বলেন, ‘ঔপনিবেশিক কাঠামো ধ্বংস করতে হলে, কেবল নৈতিক আহ্বান নয়, প্রয়োজন বিপ্লব।’

মার্টিনিক থেকে আলজেরিয়া, সেখান থেকে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা ফ্যাননের ভাষা হয়ে উঠল মুক্তিকামীদের মুখপাত্র। তার চিন্তাধারা আজও প্রতিধ্বনিত হয় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে, পোস্টকলোনিয়াল তত্ত্বে এবং শিল্প-সাহিত্যের ভিন্নধারায়।

নতুন ইশতেহার কোথায়

আজ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু বিপর্যয়, পুঁজির অতিনিয়ন্ত্রণ বা সামাজিক বৈষম্য নতুন চেহারায় ফিরে আসে, তখন প্রশ্ন ওঠে এখনকার সময়ের বিপ্লবী ইশতেহার কোথায়? কাদের লেখায় ধ্বনিত হয় নতুন কালের বিদ্রোহ?

সম্ভবত, এসব ইশতেহার এখন কবিতায়, ব্লগে, মঞ্চনাটকে, কিংবা প্রতিবাদী চিত্রকলায় ছড়িয়ে আছে হয়তো তারা একদিন ঠিকই ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেবে।

যেসব পান্ডুলিপি আগুন জ্বালায়

কখনো কখনো ইতিহাস ঘুরে দাঁড়ায় একটি মাত্র লেখায়। একটি পা-ুলিপি, যা শুধু কাগজে লেখা শব্দ নয়, বরং সময়ের নীরবতাকে ভেঙে ফেলা এক ধ্বনি। এসব লেখা প্রশ্ন তোলে, জবাব দাবি করে, আর অনেক সময় শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে এনে তুলে দেয় মানুষের হাতে। নিচে আরও এমন কিছু ঐতিহাসিক লেখার কথা থাকল, যেগুলো শুধু সাহিত্য ছিল না, ছিল বিপ্লবের ইশতেহার। মানব ও নাগরীকের অধিকারের ঘোষণা (১৭৮৯) ফরাসি বিপ্লবের আদর্শিক ভিত্তি।

মানুষ স্বাধীন জন্মায় এবং সমান অধিকার নিয়ে বাঁচে : ফরাসি বিপ্লবের সময়ে এই ঘোষণাটি ছিল শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট যুদ্ধঘোষণা। এই লেখাটি রাজতন্ত্র, চার্চ ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার গায়ে প্রথম নৈতিক আঘাত হানে। সম্পত্তির অধিকার, বাকস্বাধীনতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা এই ধারণাগুলো এখন যতটা সাধারণ মনে হয়, তখন ততটাই বিপজ্জনক ছিল। এটি আধুনিক মানবাধিকারের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে ওঠে।

সোভিয়েত সংবিধান (১৯১৮) : রাশিয়ান বিপ্লবের পর রাষ্ট্র রূপান্তরের দলিল বিপ্লবের পরে কীভাবে একটি ‘জনগণের রাষ্ট্র’ গড়ে তোলা হবে? এই প্রশ্নের জবাব ছিল ১৯১৮ সালের সমাজতান্ত্রিক সংবিধান। এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম সংবিধান, যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়, ক্ষমতা থাকবে শ্রমিক ও কৃষকের হাতে, উৎপাদন ব্যবস্থার হবে জাতীয়করণ এবং পুঁজিবাদ বিলুপ্ত হবে। এটি ছিল এক সরকারি দলিল, কিন্তু আদতে ছিল এক গভীর আদর্শিক ইশতেহার, যা একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ার নকশা দিয়েছিল।

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস : একজন ভিক্ষুর হাতেই ধর্মীয় সংস্কারের সূচনা মার্টিন লুথার, এক নিরীহ সন্ন্যাসী, গির্জার দরজায় পেরেক ঠুকে লাগিয়ে দিলেন ৯৫ দফার প্রতিবাদপত্র। এই লেখায় তিনি ক্যাথলিক চার্চের রহফঁষমবহপব বিক্রির মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ জুড়ে। এ ছিল এক বিশাল সংস্কারের সূচনা, যা শুধু ধর্ম নয়, শিক্ষা, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকেও পাল্টে দিয়েছিল। এক অর্থে এটি ছিল ধর্মীয় একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে দেওয়ার প্রথম সাহসী পান্ডুলিপি।

বার্মিংহাম জেলও থেকে লেখা চিঠি-মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯৬৩) : জেল থেকেই লেখা এক নৈতিক প্রতিরোধের দলিল ‘Wherever injustice exists, justice is threatened everywhere’ যেকোনো জায়গায় অবিচার, সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ, এই একটি বাক্যেই ফুটে ওঠে মার্টিন লুথার কিং-এর দৃষ্টিভঙ্গি। জেল থেকে লেখা এই চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক তাত্ত্বিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তির মহাকাব্য। এটি বলেছিল, শান্তিপূর্ণ অসহযোগ কীভাবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিকল্প হতে পারে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, এটি হয়ে ওঠে বিশ^ জুড়ে মানবাধিকার আন্দোলনের এক নৈতিক রেফারেন্স পয়েন্ট।

চার্টার ৭৭চেকোস্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা-ইশতেহার, নীরবতা ভেঙে দেওয়ার সাহস : সোভিয়েত শাসনের মধ্যে বসবাসকারী কিছু সাহসী নাগরিক, লেখক ও শিল্পী প্রকাশ করলেন এক ঘোষণাপত্র, যেখানে সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, আমরা নীরব থাকব না। ‘চার্টার ৭৭’ ছিল স্রেফ একটি বিবৃতি নয়; এটি ছিল পূর্ব ইউরোপের স্বৈরাচারী শাসন ভেঙে গণতান্ত্রিক স্বপ্ন দেখার প্রথম সাহস। এটি আজও প্রতিবাদের নৈতিক সৌন্দর্য ও শক্তির উদাহরণ হয়ে আছে।

আমারে কবর দিও হাঁটুভাঙার বাঁকে ডি ব্রাউন (১৯৭০) : নেটিভ আমেরিকানদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ বিলাপ এই বই ইতিহাস নয়, ইতিহাসের প্রতিবাদ। এটি বলেছে কীভাবে আমেরিকার মূল জনগোষ্ঠীকে হত্যা, উচ্ছেদ ও সাংস্কৃতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায় যেন একেকটি জাতিগোষ্ঠীর শেষ নিঃশ্বাস। এটি এক দীর্ঘ বিলাপ, এক অনিঃশেষ রাগ যা শুধুই ইতিহাস বলার জন্য নয়, ইতিহাসকে প্রশ্ন করার জন্য লেখা। লেখাটি নেটিভ আমেরিকানদের নিঃশব্দ কান্নাকে বিশ্ব দরবারে উচ্চারণে রূপ দেয়। একটি লেখা কবে ইশতেহার হয়? যখন তা কেবল তাত্ত্বিক নয়, অন্তরের দাবিও হয়। যখন তা নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, প্রান্তিক কণ্ঠকে তুলে ধরে এবং নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায় তখনই তা হয়ে ওঠে ইশতেহার। এসব লেখাই আমাদের দেখিয়ে দেয়, বিপ্লব শুধু বন্দুক দিয়ে হয় না, কলমও হতে পারে বিস্ফোরক।

আমাদের সময়ে, এসব ইশতেহার নতুন করে পড়া দরকার যাতে আমরা বুঝতে পারি, কতটা শব্দ লাগতে পারে একটা আগুন ধরাতে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত