হাফেজ মাওলানা মুফতি আহমদ যাকারিয়া যুক্তরাজ্য প্রবাসী তরুণ আলেম ও লেখক। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় জন্ম নেওয়া এই চিন্তাশীল ২০১৬ সালে দাওরায়ে হাদিসে পাস করে ইসলামি আইন ও হাদিসের ওপর উচ্চতর গবেষণা করেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু, পরে চলে যান লন্ডন। সেখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামি ঐক্যসহ সমসাময়িক প্রসঙ্গে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু ইফফাত
দেশ রূপান্তর : আলেম সমাজের ঐক্য নিয়ে আপনার মতামত কী?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : প্রথমত আলেম সমাজের পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক মজবুত করতে হবে, অনাকাক্সিক্ষত ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে হবে। বিগত দিনের বিভিন্ন আন্দোলন ও উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আলেমদের মধ্যে যেসব দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেগুলো আগে পরিপূর্ণরূপে মিটমাট করতে হবে। সবাইকে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এর স্বরূপ, বাস্তবতা, কর্মপদ্ধতি, কর্মপন্থা, কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। আমরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নই, বরং সহযোগী, এই বিশ্বাস আগে অন্তরে জায়গা দিতে হবে। তাহলে আশা করা যায়, একটা সুন্দর পরিণতির দিকে আগানো সম্ভব হবে।
দেশ রূপান্তর : ঐক্য প্রক্রিয়া কেমন হওয়া দরকার বলে মনে করেন?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : প্রথমত বিগত সময়ে যারা অন্যের ক্রীড়নক হয়ে আলেমদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হবে সেটা নির্ণয় হওয়া দরকার বলে মনে করি। ভবিষ্যৎ বিভক্তি ঠেকাতে ক্ষমার নীতি অবলম্বন করা কাম্য। এ বিষয়ে যদি নেতৃবৃন্দ আন্তরিকতা দেখান, তাহলে হয়তো উম্মতের দীর্ঘমেয়াদি ফায়দা হবে।
দেশ রূপান্তর : আলেমদের সামগ্রিক ঐক্য নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : ইসলামপন্থিদের হীনমন্যতা ছাড়তে হবে। জাতীয় পটপরিবর্তনে গৌরবময় ভূমিকা রাখার পর সৎসাহসী হতে হয়। আর দেশ ও জনগণকে নিজের মনে করে চিহ্নিত শত্রুদের বিরুদ্ধে সরব হওয়া দরকার। এই চিহ্নিত শত্রু হতে হবে ইসলামবিরোধী ও দেশবিরোধী শক্তি। আলেমরা যদি একে অপরের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়, তাহলে এ দেশে ইসলামের বিজয় সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে যেকোনোভাবেই হোক অংশগ্রহণের সুযোগকে কাজে লাগানো দরকার। পারস্পরিক বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা উচিত। নতুন নতুন ইস্যুতে ঝাঁপিয়ে না পড়াই হবে আলেমদের জন্য কল্যাণের।
দেশ রূপান্তর : কওমি ধারার ইসলামি রাজনৈতিক দলের ঐক্য সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের ঐক্যের আগে যেসব রাজনৈতিক দল বিভিন্ন গ্রুপ ও উপদলে ভাগ হয়েছে তাদের এক কাতারে আসার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কারণ ভেতরে ঘা রেখে ওপরে প্রলেপ দেওয়ার চেয়ে মূলে কাজ করে সেখানে উপশম হলে দীর্ঘস্থায়ী একটা ফায়দার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এখনই সব দলের রাজনৈতিক ঐক্য না হয়ে মান-অভিমান ভুলে আগে একই নামের বিভক্ত দলগুলোকে এক করে পরে সব ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের ঐক্যের কথা চিন্তা করলে হয়তো ভালো হবে।
দেশ রূপান্তর : রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আলেমদের না থাকার কারণ কী?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার করতে এবং সমাজের মন-মগজে যথাযোগ্য স্থান পেতে প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। এজন্য দরকার স্বীকৃতি এবং সেটার কার্যকারিতা। কর্মক্ষেত্রে কওমি সনদের বহুমুখী কার্যকারিতায় দেশেরই বেশি লাভ হবে। কওমিয়ানদের উপযোগী ক্ষেত্রগুলোতে যদি সরকার তাদের কাজের সুযোগ দেয়, তাহলে সততায় তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা করি। এজন্য এবার বৈষম্য দূর হোক এবং কওমির সন্তানরা তাদের অধিকার লাভ করুক। কারণ এই বিশেষায়িত শিক্ষার সঙ্গে অনুকূল ও যথাযোগ্য ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ পাওয়াটা কওমিয়ানদের নাগরিক অধিকার। এটা তাদের প্রতি দয়া নয়। কওমি পড়–য়াদের মধ্যে যেমন সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়নীতি ও খোদাভীতি আছে, তেমনি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও কর্মদক্ষতা রয়েছে। সুতরাং স্বীকৃতি কার্যকর করা হলে কওমি ওলামায়ে কেরাম যতটুকু উপকৃত হবেন, রাষ্ট্র ও জনসাধারণ তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ।
দেশ রূপান্তর : সরকার দাওরায়ে হাদিসের সার্টিফিকেটের যে মান দিয়েছে সেটার দ্বারা রাষ্ট্রে অংশগ্রহণমূলক প্রতিযোগিতা কতটুকু সম্ভব?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : বিগত সরকার এটার এমন মান দিয়েছে, যা কোনো কাজে আসে না। দাওরায়ে হাদিসের মান মাস্টার্স দিলেও এটা দিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার আবেদন করা যায় না। কেননা এই সনদের মান সম্পর্কিত কোনো ডাটা বাইরের রাষ্ট্রের সার্ভারে নেই। আবার দাওরায়ে হাদিসের সার্টিফিকেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমফিলও করা যায় না। এ সার্টিফিকেট দিয়ে সরকারি চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা আছে। কর্মক্ষেত্রে এ সার্টিফিকেট কতটা কার্যকরী তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। এই সার্টিফিকেটের অধিকারীরা সরকারিভাবে ঠিক কী কী চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ পাবেন, এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি বিগত সরকার। রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে চাকরির আশা তারাও করেন না; বরং তাদের দাবি এতটুকুই যে, যে বিষয়ের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) ওপর তাদের মাস্টার্সের সমমান স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সরকারি সেসব সেক্টরে অন্তত তাদের চাকরির সুযোগ দেওয়া হোক। এতে যেমন কওমি শিক্ষা সমাপনকারীদের বড় একটি অংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, তেমনি রাষ্ট্রও সৎ, আমানতদার ও আন্তরিক একঝাঁক কর্মী পাবে।
দেশ রূপান্তর : দাওরায়ে হাদিসের সার্টিফিকেট নিয়ে আপনার মতামত কী?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : হাইয়াতুল উলয়ার তত্ত্বাবধানে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দাওরায়ে হাদিসের সার্টিফিকেটের মান নিয়ে আলোচনা করা দরকার। এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের সার্টিফিকেট না থাকা সত্ত্বেও এটা কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বসা দরকার। যদি এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের সার্টিফিকেট না থাকায় এগুলো কার্যকর করতে সমস্যা হয়, তাহলে এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের সার্টিফিকেট আদায়ের লক্ষ্যে এসএসসির জন্য হেদায়াতুন্নাহু এবং এইচএসসির জন্য শরহে জামিকে সমমান করে বোর্ড পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় কি না তা চিন্তা করা দরকার বলে মনে করি।
দেশ রূপান্তর : কওমি মাদ্রাসাকে অনেকে পশ্চাৎপদ চিন্তার বলে জঙ্গি ও মৌলবাদী ট্যাগ দিয়ে থাকেন, এ বিষয়ে কী বলবেন?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বাইরে মতামত প্রদান করা কারও পক্ষেই উচিত নয়। এটি একটি সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি এবং সাধারণ ভদ্রতা। বাংলাদেশে ইলমে দ্বীনকে যথাসম্ভব বিশুদ্ধতা, নির্ভরযোগ্যতা ও আমানতদারী রক্ষা করে ইসলামের নিখুঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের যে কার্যক্রম কওমি মাদ্রাসার মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে, তা তুলনামূলকভাবে অধিকতর শ্রেষ্ঠ, উম্মতের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং অধিকতর ফলপ্রসূ। দ্বীনি শিক্ষার এই কেন্দ্রগুলোকে কোনো কোনো সমালোচক ভুলবশত অসত্য বিশেষণে চিত্রায়িত করতে চান। এগুলো অপ্রয়োজনীয় কাজ। সত্য কথা হলো, যে যা মনে করুক বা বলুক, কওমি মাদ্রাসার বর্তমান এ শিক্ষাধারা দ্বীন ইসলামের হেফাজত ও প্রচার-প্রসারে এক অতীব জরুরি বাস্তবমুখী ও ফলপ্রসূ কর্মসূচি।
দেশ রূপান্তর : ইসলামের দাওয়াতকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পৌঁছাতে কওমি মাদ্রাসার দরসে নিজামি কি যথেষ্ট?
মুফতি আহমদ যাকারিয়া : ভারত উপমহাদেশে দ্বীনের খেদমত হয়েছে তিনটি মাধ্যমে। এক. হাক্কানি পীরের খানকা। দুই. দরসে নিজামি। তিন. দাওয়াত ও তাবলিগ। এই তিনটির মূল ভিত্তি হলো দরসে নিজামির শিক্ষা। এখনো পৃথিবীর যত জায়গায় দ্বীনের সহিহ খেদমত হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দরসে নিজামির অবদান। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দরসে নিজামির মধ্যে মৌলিক বিষয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভা অনুযায়ী এর সঙ্গে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন বলে মনে করি। কেননা শিক্ষাকে কোনো অবস্থাতেই বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। শিক্ষা একটি চলমান প্রবাহ, চলতে চলতে তা নানা রূপে, নানা বর্ণে, নানা পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়। দ্বীনের সহিহ শিক্ষার এই স্রোতধারা হয়তো যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কখনো কখনো কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন গ্রহণ করবে, কিন্তু সহিহ শিক্ষার ব্যবস্থা কেয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ায় অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।