নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম কাশ্মীরে পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্যস্থল পেহেলগাম। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ উপত্যকাটিতে আসেন এ প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে। তবে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামের বৈসরণে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে আছে দেশটি। এ ঘটনায় প্রতিবেশী পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে ভারত। যার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছে। দুই দেশের তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে উঠেছে আরও তিক্ত। মঙ্গলবারের এ হামলা পর্যটননির্ভর কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি চিরবৈরী দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
মঙ্গলবারের রক্তপাতের ঘটনাকে ২০১৯ সালের পর থেকে সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গি হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বন্দুকধারীদের ওই হামলায় কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই কাশ্মীরকে পুরোপুরি নিজেদের বলে দাবি করলেও তা তারা আংশিকভাবেই শাসন করে। কাশ্মীরের ভঙ্গুর ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, বৈসরণে হামলার ঘটনায় ভারতের আসন্ন প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ‘বল প্রয়োগের’ একটা সম্পর্ক থাকবে। মঙ্গলবারের হামলা শুধু মানুষের জীবনের ওপরই নয়, বিরোধপূর্ণ এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনতে দীর্ঘ প্রচেষ্টার ওপরও একটা পরিকল্পিত আক্রমণ বলে মনে করা হচ্ছে। পেহেলগামের ঘটনার জবাব দিতে দিল্লি দ্রুত বেশ কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এ তালিকায় প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, একটা গুরুত্বপূর্ণ জল বণ্টন চুক্তি স্থগিত করা এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও রয়েছে। পাল্টা জবাবে ভারতীয় এয়ারলাইনসের জন্য আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তানও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে প্রশ্ন এটা নয় যে, সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে কি না। বরং প্রশ্ন হলো সেটা কখন হবে, তার মাত্রা কী হবে এবং তার ফলে কী মূল্য দিতে হতে পারে। সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেছেন, আমরা সম্ভবত একটা দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব যা ঘরোয়া দর্শক এবং পাকিস্তানে থাকা অভিনেতা দুপক্ষকেই একটা বার্তা দেবে। ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষত ২০১৯ সালের পর থেকে এই জাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা হলো আন্তঃসীমান্ত হামলা বা বিমান হামলা। ফলে সেই মাত্রার নিচে কোনো কাজ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। অনুমান করা যায়, পাকিস্তানও আগের মতোই জবাব দেবে। এ ক্ষেত্রে বরাবরের মতোই যে ঝুঁকিটা থেকে যায় সেটা হলো, হিসাবে ভুল, যা উভয়পক্ষেরই হতে পারে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বারামুলা জেলার উরি অঞ্চলে হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছিল ভারত যেটাকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সে সময় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় আধাসামরিক বাহিনীর অন্তত ৪০ জনের মৃত্যুর পর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। তার দুই বছর পর ২০২১ সালে তারা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরস্পরের সীমান্তে গুলি বন্ধ করতে সম্মত হয় উভয় দেশ। পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, সর্বশেষ হামলায় ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করার মতো ঘটনা এবং এতগুলো মানুষের মৃত্যু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়ার জোরালো সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তিনি বিবিসিকে বলেন, ভারতের জন্য এ জাতীয় প্রতিক্রিয়ার প্রধান সুবিধা হবে রাজনৈতিক দিক থেকে। কারণ জোরালো জবাব দেওয়ার জন্য তাদের ওপর ভারতীয় জনসাধারণের প্রবল চাপ থাকবে। আরেকটা সুবিধা হলো, যদি প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সফলভাবে সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুকে নির্মূল করা সম্ভব হয়, তাহলে তা প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ভারতবিরোধী হুমকিকে হ্রাস দুই-ই করতে পারে। তবে একই সঙ্গে গুরুতর সংকট সৃষ্টি ও সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন কুগেলম্যান।
ভারতের কাছে বিকল্প কী?
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানি’র ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, এ পরিস্থিতিতে ভারতের সামনে দুটো সম্ভাব্য পথ খোলা থাকবে। প্রথমত, ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখায় যে ‘সিজ ফায়ার’-এর জন্য দুপক্ষ সম্মত হয়েছিল, তা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সীমান্তে আবার গুলি চালানোর জন্য সবুজ সংকেত দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালের মতো বিমান হামলা বা এমনকি প্রচলিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও সম্ভাব্য পথ হিসেবে ভারতের সামনে খোলা আছে। তবে তিনি জানিয়েছেন, এ জাতীয় প্রতিটি প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ কিন্তু পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বহন করে। যেমনটা এর আগেও দেখা গেছে। তিনি বলেন, কোনো পথই ঝুঁকিমুক্ত নয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির গবেষক মি. ক্ল্যারি বলেছেন, ভারতের অন্যতম প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের নানা বিষয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। ফলে উদ্ভূত এ সংকট ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করতে তারা ইচ্ছুক বা সক্ষম নাও হতে পারে। ভারত-পাকিস্তান সংকটের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, দুপক্ষই পরমাণু শক্তিধর। এ সত্যিটা দুই দেশের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওপর দীর্ঘ প্রভাব ফেলে। সেটা শুধু সামরিক কৌশল তৈরির সময় নয়, বরং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সামরিক ইতিহাসবিদ রাঘবন বলেছেন, পারমাণবিক হাতিয়ার একই সঙ্গে বিপজ্জনক এবং নিয়ন্ত্রক (কাউকে বাধা দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিক থেকে)। এটা দুপক্ষের নীতিনির্ধারকদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করে। যেকোনো প্রতিক্রিয়া সুনির্দিষ্ট এবং লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করে হতে হবে। তার মতে, পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিতে পারে এবং তারপর সেখান থেকে সরে এসে আবার অন্য পথ অনুসরণ করতে পারে। তিনি আরও বলেন, একটা ঝুঁকি সবসময়ই থাকে যে, সবকিছু চিত্রনাট্য অনুযায়ী নাও এগোতে পারে। ফলে ভারতের পক্ষ থেকে এ প্রতিক্রিয়ার রাজনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধাগুলোকে চিন্তা করতে হবে গুরুতর সংকট বা সংঘাতের ঝুঁকির মাথায় রেখে।
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেন হক্কানি মনে করেন, ২০১৬ সালের মতো সীমিত পরিসরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর বিষয়ে যদি ভারত বিবেচনা করে তাহলে এবার উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আনোয়ার গারগাশ ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমি ও হাডসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো হুসেন হক্কানি বিবিসিকে বলেন, ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের হামলা চালানোর ক্ষেত্রে সুবিধা হলো এগুলোর পরিধি সীমিত। তাই পাকিস্তানকে এর জবাব দিতে হয় না। কিন্তু ভারতের জনসাধারণের সামনে এটি প্রতীয়মান হবে যে, সরকার জবাব দিতে একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ যুক্তি দিতে পারে যেকোনো তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই তাদের দোষারোপ করা হচ্ছে। হুসেন হক্কানি বলেন, ভারত যে পথই বাছুক এবং পাকিস্তান তার যে জবাবই দিক না কেন, প্রত্যেকটা পদক্ষেপই ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
সাম্প্রতিক আবহে উত্তেজনা বৃদ্ধির হুমকি ঘনিয়ে আসছে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরের ভঙ্গুর শান্তি নাগালের আরও বাইরে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ভারতকে অবশ্যই নিরাপত্তার ব্যর্থতার বিষয়টাও বিবেচনা করতে হবে, যার কারণে এ হামলা হয়েছে। শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, পর্যটন মৌসুমের যখন শীর্ষে তখন এ জাতীয় হামলা চালানো হয়েছে। এটা একটা গুরুতর ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করে। বিশেষত এমন একটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে।
হামলাকারীদের পরিচয়
হামলার সঙ্গে জড়িত চার বন্দুকধারীর মধ্যে তিনজনের স্কেচসহ নাম প্রকাশ করা হয়েছে। পুলিশের বরাত দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানায়, চিহ্নিত তিনজনের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক। আরেকজন অনন্তনাগের স্থানীয় বাসিন্দা। তবে চতুর্থ সন্দেহভাজনের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। হামলাকারীরা হলেন পাকিস্তানের নাগরিক হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান, আলি ভাই ওরফে তালহা ভাই এবং জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বাসিন্দা আবদুল হুসেন ঠোকার। ভারতীয় পুলিশের দাবি, এ তিনজন হামলাকারীই পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। হামলার পরই এর দায় স্বীকার করেছে লস্কর-ই-তৈয়বার প্রক্সি শাখা ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। সংগঠনটিকে দুই বছর আগে নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার।