শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

দুর্ঘটনা নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড?

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৫৫ এএম

২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১২ বছর পার হয়ে গেল। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কারখানা দুর্ঘটনা হিসেবে রানা প্লাজা ভবন ধসকে বিবেচনা করা হলেও তা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়েছে কতটুকু তা এখনো প্রশ্ন সাপেক্ষ। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালের এই ভবন ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১৩৮ জন, যাদের মধ্যে ২৯১ জনের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের সমাধিস্থ করা হয়েছে জুরাইনে অচিহ্নিত শ্রমিকদের কবরস্থানে। এই ভবন ধসের ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ২৫০০ জন। এই ভয়াবহ কাঠামোগত হত্যার মাত্র ৫ মাস আগেই ২০১২ সালে তাজরিন অগ্নিকান্ডে জীবন হারিয়েছিলেন ১১২ জন। তার দগদগে স্মৃতি মন থেকে মুছে যেতে না যেতেই রানা প্লাজা ভবন ধস শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ১২ বছর পর হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা যতটা আবেগকে নাড়া দিয়েছিল ততটা দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করেনি সংশ্লিষ্ট কাউকে। ফলে ২০১৬ সালে টাম্পাকো এবং ২০১৭  সালে মাল্টি ফ্যাবস কারখানা অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ছোট-বড় নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে যেমন, তেমনি বড় দুর্ঘটনারও বিরাম নেই। ২০২১ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লেগে ৫২ জনের মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় সস্তা শ্রমিকের জীবনটাও কত অবহেলার। 

শ্রমিক কাজ করতে আসে জীবনকে উন্নত করতে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু যেন শ্রমিকদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেফটি অ্যান্ড রাইটস নামের একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর খবর জরিপ করে দেখানো হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৬৮১ জন। অগ্নিসচেতনতা, অগ্নিসতর্কতা আর অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা এতই নাজুক যে, বলা হয় প্রতি ২ দিনে একটি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। বড় আকারের প্রতিষ্ঠান এবং বেশি পরিমাণ প্রাণহানি না ঘটলে তা সাড়া ফেলে না, শোরগোল তোলে না। আড়ালেই থেকে যায় দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর খবর। কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে শ্রমজীবী পরিবারগুলো যে কি অসহায় হয়ে পড়ে তা নজরে আসে না অনেক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে পেশাগত দুর্ঘটনার বিলস কর্র্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১২ বছরে (২০১৩-২০২৪) ১০ হাজার ২১০ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে যেসব শিল্পকারখানা/ প্রতিষ্ঠানে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে (যেমন সারাকা গার্মেন্টস, স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টস, রানা প্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস, টাম্পাকো ফয়েলস, বিএম ডিপো, সজীব ফুডস, নিমতলী ট্র্যাজেডি, বেইলি রোড ট্র্যাজেডি, এসএন করপোরেশনের গ্রিনইয়ার্ড ইত্যাদি) এবং পরবর্তী সময় বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি কর্র্তৃপক্ষ কর্র্তৃক তদন্ত করা হয়েছে, তার প্রতিবেদন কখনই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তা অন্ধকারে রয়ে গেছে।

রানা প্লাজা ভবন ধসের পর কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। এসব দুর্ঘটনা কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড? দুর্ঘটনাগুলো কি আকস্মিক নাকি অনিবার্য ছিল? কেউ বা কারা কি এর দায় নেবে না? বাংলাদেশে চাইলেই কি কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যায়? প্রায় ১৭টি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যায় না। ফ্যাক্টরি প্ল্যান পাস করাতেই তো জমির কাগজপত্র লাগে, সাইট প্ল্যান, মাস্টার প্ল্যান লাগে, কনস্ট্রাকশন প্ল্যান লাগে, মেশিন লে আউট ও ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্লো চার্ট লাগে। তাহলে ভবন ধসের পর সংগতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, ভবন নির্মাণের অনুমতি দেন যারা তারা কি দায়িত্ব পালন করেছিলেন? কারখানা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কি নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়? এখানে দুর্নীতি না দায়িত্বহীনতা কোনটা প্রধান সমস্যা? নাকি দুর্নীতির কারণেই নিয়ম থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বে অবহেলা করা হয়েছিল? আইন নাগরিককে সুরক্ষা দেয়। প্রশ্ন উঠে সেখানেও। আইন কোন ধরনের নাগরিককে সুরক্ষা দেয়? ক্ষমতাবানের ক্ষমতার সুরক্ষা নাকি দুর্বলের ন্যূনতম অধিকারের সুরক্ষা? একটি অপরাধ বা অন্যায়ের শাস্তি হলে যেমন অপরাধ প্রবণতা কমতে থাকে, তেমনি অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল  স্পেকট্রাম কারখানার ভবন ধসে ৮০ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর যদি কর্র্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিত তাহলে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার দুঃখজনক ঘটনা হয়তো ঘটত না।

রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম আইন সংশোধন হয়েছে দুবার। একবার ২০১৩ সালে আর একবার ২০১৮ সালে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের এবং পূর্ণ কর্মক্ষমতা হারানো আহতদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। মৃত্যুবরণ করলে পরিবার পাবে ২ লাখ টাকা এবং চিরস্থায়ী পঙ্গু হলে আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কী হাস্যকর, নাকি উপহাসের শামিল তা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে। কিন্তু একজন মানুষের জীবনকে এবং জীবিকাকে যে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক করার প্রবৃত্তি নিশ্চয়ই কারও হবে না। দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এই আয় বৃদ্ধিতে শ্রমজীবীদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।  কিন্তু তাদের প্রতি দায়িত্ব প্রতি পদে পদে অস্বীকার করা হচ্ছে, এমনকি কর্মক্ষেত্রে নিহত বা আহত হওয়ার পরেও। মাথাপিছু আয় ২৭৮৪  ডলার হিসেবে একজন শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যে কোনো বয়সী নাগরিকের আয় বার্ষিক ৩  লাখ ৩০ হাজার টাকার বেশি। আর উৎপাদনের চাকা ঘোরান যারা, তাদের জীবনের চাকা থেমে গেলে ক্ষতিপূরণ ২ লাখ টাকা। শ্রমিকের জীবন নিয়ে একি তামাশা নয়? এই তামাশা শেষে বিয়োগান্তক বেদনা ও অপমানে পর্যবসিত হয় যখন সেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্যও বছরের পর বছর ঘুরতে হয়।

রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ হয়েছিল অবৈধভাবে, ফাটল দেখা যাওয়ার পর শ্রমিকরা কাজে যেতে চায়নি। তাদের জোর করে কাজে পাঠানো হয়েছে। শ্রমিকরা চাকরি হারাবার ভয়ে কাজে যোগ দিয়েছে। ভবনে জেনারেটর নিয়মানুযায়ী স্থাপন করা হয়নি। ভবন ধসের পর বিরোধী দলের কর্মীরা পিলার ধরে ঝাঁকি দিয়েছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন, ৫টি কারখানায় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, কিন্তু কোনো ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না সেখানে এসব তথ্য কি প্রমাণ করে? শ্রম দপ্তর, পরিদর্শন দপ্তর এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেউ কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন, দায় এড়াতে পারবেন কি কেউ? দেখা গেছে, ২৯টি ব্র্যান্ড রানা প্লাজায় অবস্থিত ৫টি ফ্যাক্টরিতে তৈরি পোশাকের অর্ডার দিত। তাদের কি কোনো দায় ছিল না কর্ম পরিবেশ দেখার ব্যাপারে? একটা হিসাব দাঁড় করিয়েছিল ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন নামের একটি সংস্থা। তারা দেখিয়েছে একটি টি-শার্টের বিক্রয় মূল্যের মাত্র দশমিক ৬ শতাংশ পান শ্রমিক অর্থাৎ ১০০  টাকার টি-শার্টে শ্রমিকের প্রাপ্তি মাত্র ৬০ পয়সা। কারখানা মালিক ৪ শতাংশ পান লাভ হিসেবে, ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা ব্র্যান্ড পায় ১২ শতাংশ আর ইউরোপ-আমেরিকার বিক্রেতা পায় ৫৯ শতাংশ। ফলে শ্রমিকরা রক্ত পানি করা শ্রমে মুনাফা জোগায় দেশি-বিদেশি মালিকদের। যে কারণে শ্রমিক ভবনের নিচে চাপা পড়লে কিংবা আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করলে তা দেখা যায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত যে লোভের আগুনে পুড়ছে কিংবা লাভ বা মুনাফার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ছে তা কিন্তু সহজে চোখে পড়ে না। রানা প্লাজা ভবন ধস দেখিয়েছে অনেক, কিন্তু শিখিয়েছে কিছু?  শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা, ন্যায্য মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ, আহতদের চিকিৎসা পুনর্বাসনের কাজে যে অনেক পিছিয়ে আমরা, প্রতি বছর রানা প্লাজা দিবস সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশে ৭ কোটি ৪০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ, এরাই উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি। কলকারখানা, কৃষি ক্ষেত্র, সেবা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান অর্থবছরে ৫০ লাখ কোটি টাকার বেশি সম্পদ সৃষ্টি করবে তারা, যাকে আমরা জিডিপি বলি। দেশের রপ্তানি আয় ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গার্মেন্ট খাত থেকে গত বছর ৪৬ বিলিয়ন ডলার বা ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ। শ্রমিকের শ্রমের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়, জিডিপি বাড়ে কিন্তু সবচেয়ে কম মজুরি পায় তারা। গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বনিম্ন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এরপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। তাদের শ্রম যেমন সস্তা, জীবনটাও তেমনি কমদামি। শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যু হলে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ নিয়ে শ্রমিক সংগঠন এবং সমাজসচেতন মানুষের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কর্মক্ষম মানুষের জীবনের মূল্য কি এত কম? একজন কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু মানে একটি পরিবার পথে বসে যাওয়া। আর যদি পঙ্গু হয় তাহলে পরিবারের জন্য সে এক ভয়াবহ বোঝা, সমাজের কাছে করুণার পাত্র হয়ে পড়ে। শ্রমিকের শ্রম দিয়ে একদল মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে, বিদেশে টাকা পাচার করে। অথচ সেই শ্রমিক শ্রমের ন্যায্য মজুরি পায় না, কাজ করতে এসে মৃত্যুবরণ করে পঙ্গু হয়, তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় না। কী অদ্ভুত ব্যবস্থা! রানা প্লাজা ধস দেখিয়েছে দায়হীনতা এবং উদাসীনতা শ্রমিকদের জীবনকে কীভাবে অসহায় করে রেখেছে। শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মক্ষেত্রে নিহত বা আহত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া, আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন, ঘটনার বিচার এবং দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা দূর করার কাজ এখনো অনেক বাকি।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত