মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আল্লাহ প্রথমে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। তারপর তার থেকে মানব জাতির বংশ বৃদ্ধি ঘটান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর শুক্রাণু থেকে, জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, তারপর পূর্ণ আকৃতি ও অপূর্ণ আকৃতি বিশিষ্ট মাংসপিণ্ড থেকে, তোমাদের কাছে (আমার ক্ষমতা) ব্যক্ত করার জন্য। আর আমি নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দিই, এরপর শিশু অবস্থায় বের করি।’ (সুরা হজ ৫)
শিশু অনুকূল পরিবেশে বাবা-মায়ের লালন-পালনে বেড়ে ওঠে কিশোর, যুবক ও প্রৌঢ়ের পর বার্ধক্যে উপনীত হয়। এরপর আস্তে আস্তে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ও বোধশক্তি আবার শিশুদের মতো হয়ে যায়। জন্ম থেকে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ যেকোনো অবস্থায় আমাদের মৃত্যু হয়ে যেতে পারে। মহান আল্লাহর বেঁধে দেওয়া আয়ুষ্কাল নিয়ে আমাদের দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে। দুনিয়াতে এই সময়কালটা আমাদের কেন দেওয়া হলো? মানুষের উচিত, মহান আল্লাহর সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা এবং সেই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য স্বল্পকালীন জীবনকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মাটি থেকেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং মাটি থেকেই তোমাদের পুনরায় বের করে আনব।’ (সুরা তাহা ৫৫) এ আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য জন্ম, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বিষয়টি একসঙ্গে তুলে ধরেছেন।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা, তাদের সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণ সাধন করার জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো। আর আল্লাহকে বিশ্বাস করো।’ (সুরা আলে ইমরান ১১০) এ আয়াত থেকে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝা যায়। কেননা বলা হয়েছে, যারা এই কাজ করবে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি।
সৎকাজের আদেশ বলতে সাধারণত কাউকে ন্যায় ও ভালো কাজের নির্দেশ দান করা বোঝায়। আর অসৎকাজের নিষেধ হলো যাবতীয় মন্দ, খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে কাউকে বিরত রাখা। যেসব কাজ ইসলাম সমর্থন করে না এবং যেসব কাজ নীতি-নৈতিকতা ও বিবেক-বুদ্ধি বিরোধী, সেসব কাজ থেকে কাউকে নিষেধ করা, বিরত রাখা, নিরুৎসাহিত করা, বাধা দেওয়া ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ একটি কল্যাণকর কাজ। সৎকাজ করা এবং অসৎকাজ থেকে বিরত থাকা যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির অবশ্য কর্তব্য, তেমনি অন্যকে সৎকাজের জন্য আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করাও পবিত্র দায়িত্ব।
আমাদের প্রত্যেকটি সৎকাজ মানবজাতির কল্যাণ ও সুখের এবং প্রত্যেকটি মন্দ কাজ মানবজাতির অকল্যাণ ও অশান্তির উৎস। সৎকাজ বাস্তবায়ন ও অসৎকাজ বর্জন মানুষকে সৎ মানুষ হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং সৎ মানুষ মানুষের কল্যাণ ও আনন্দের উৎস হয়। পক্ষান্তরে নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড চর্চা বা বর্জন না করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অসৎ মানুষে পরিণত করে এবং তারা পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনে মানবজাতির অকল্যাণ ও অশান্তির উৎস হয়।
মানবজাতি আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।’ (সুরা জারিয়াত ৫৬) সব নবী ও রাসুলকে প্রেরণ করা করা হয়েছিল মানবজাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির কাছে রাসুল পাঠিয়েছি এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে (বহু মাবুদ) বর্জন করো।’ (সুরা নাহল ৩৬)
আল্লাহতায়ালা আমাদের তার ইবাদত ও আনুগত্যের জন্য বারবার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন আমরা প্রতিদান লাভ করতে পারি এবং তার আজাব থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। মুসলিম মানেই আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য এবং বিশুদ্ধ নিয়ত লালনের প্রতি আদিষ্ট। এমনকি সাধারণ বৈধ কাজগুলোতেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত করাই কাম্য। তবেই সহজে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য হাসিল হবে। তাই তো আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ (সুরা আনআম ১৬২)
আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর বিভিন্ন ইবাদত ফরজ করেছেন। যেমন নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত। এ ছাড়া ইবাদতের মধ্যে আরও রয়েছে আল্লাহর জিকির করা, দোয়া করা, তাসবিহ-তাহলিল পাঠ করা, কোরআন তিলাওয়াত, বাবা-মায়ের সেবা, আত্মীয়তা রক্ষা, আমানত আদায় করা, প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা, দান-সদকা করা, রোগীর সেবা করা, এতিম-মিসকিনের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা ইত্যাদি।
একজন মুমিন-মুসলমান দিনে-রাতে পাঁচবার নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করে। তা ছাড়া সুন্নত ও নফল নামাজসহ অন্যান্য জিকির-আজকার তো আছেই। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো।’ (সুরা আহজাব ৪১-৪২)
একজন মুসলিমের সারাটা জীবনই ইবাদত। তাকে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা জীবন আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দিতে হবে। জীবনের একটি মুহূর্তও সে ইবাদতের বাইরে কাটাতে পারবে না। তাকে একদিকে যেমন আল্লাহর ইবাদতেই সমগ্র জীবন কাটাতে হবে, অন্যদিকে আল্লাহর ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করা যাবে না এবং অন্য কারও সামনে মাথানত করা যাবে না। তাহলেই মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।’ (সুরা নিসা ৩৬)