এক দেশে ছিল এক ছোট্ট শহর। শহরটা পরিচ্ছন্ন, সাজানো আর মানুষগুলোও বেশ ভালো। আর ছিল এক লোক হাকিম মিয়া। তার একটা বিশাল ঘুড়ির দোকান ছিল, সে বানাত সুন্দর সুন্দর সব ঘুড়ি। শহরের যত শিশু, সব তার দোকানের ঘুড়ি কিনে আকাশে ওড়াত। হাকিম মিয়া নিজেকে ভাবত ঘুড়ির রাজা।
হাকিম মিয়া কড়া স্বভাবের লোক, কাউকে তেমন পাত্তা দিত না। কেউ যদি পাশেই একটা ঘুড়ির দোকান খোলার চেষ্টা করত, সে ঠিকই এক কায়দায় সেটা বন্ধ করে দিত।
শহর থেকে একটু দূরে, পাহাড়ের পাদদেশে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল। গ্রামের নাম মাধবপুর। সেই গ্রামে থাকত এক কিশোর আয়ান। আয়ানের বাবা এক সময় ঘুড়ি বানাতেন, কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর সব দায়িত্ব আয়ানের কাঁধে পড়ে। সে একা হাতে ঘুড়ি বানায় রঙিন, কাগজের তৈরি, লেজে ঘণ্টা বাঁধা ঘুড়ি।
আয়ান শহরে এসে মাঠে বসে ঘুড়ি বিক্রি করত। আর তাতে হাকিম মিয়া এসে রেগে যেত এখানে বসলে আমার বিক্রি কমে যায়!
একদিন হাকিম মিয়া তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। আয়ান কাঁদে না, কিছু বলে না। সে চুপচাপ তার ঘুড়ির ঝুলি নিয়ে ফিরে যায় পাহাড়ের দিকে। সেই পাহাড়েই ছিল একটা বড় বন, আর বনের মাঝে এক শান্ত জায়গায় আয়ান বসে বসে ঘুড়ি বানাত, বানানো ঘুড়ি ওড়াতও।
একদিন সে হঠাৎ দেখে, একটা খুব সুন্দর ময়ূর বসে আছে তার পাশে। ময়ূরটা সাধারণ না, গায়ে নীল-সবুজ-সোনালি রঙের পালক অন্য ময়ূরের মতো থাকলেও চোখে যেন মানুষের মতো বুদ্ধির আভা!
আয়ান অবাক হয়ে বলে, তুমি কোথা থেকে এলে?
ময়ূর কথা বলে না, কিন্তু মাথা ঝাঁকায়। সে আয়ানের একটা ঘুড়ির দিকে তাকায়।
আয়ান হেসে বলে, এইটা আমার সবচেয়ে প্রিয় ঘুড়ি। নাম দিয়েছি নীলপরী।
ময়ূরটা ডানা ঝাপটে ঘুড়িটা নিয়ে উড়ে যায়। আয়ান দৌড়ে চিৎকার করে, আরে! ঘুড়িটা নিয়ে গেলে কেন?
পরদিন সকালে, আয়ান দেখে ময়ূরটি আবার এসেছে। আর তার সঙ্গে এনেছে একটা চকচকে বাক্স। বাক্স খুলতেই আয়ান অবাক, ভেতরে নানারকম ঘুড়ির উপাদান রেশমি
কাগজ, রঙিন সুতা, টিকটিকি আঁকা কাঠি, এমনকি হাল্কা সোনার লেজও!
ময়ূর এবার ঠোঁট দিয়ে কাগজে লিখে দিল, যারা মন দিয়ে ভালোবাসে, তাদের জন্য প্রকৃতি উপহার রাখে। বানাও ঘুড়ি, ওড়াও আকাশে, কিন্তু কারো মন ভেঙো না।
আয়ান তো এমনিতে কারও মনে দুঃখ দেয় না। বরং অন্যের কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে জেনেছে কেউ দুর্ব্যবহার করলে কত খারাপ লাগে। ময়ূরের লেখা কথাগুলো পড়ে তবু নিজে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, সজ্ঞানে কখনো অন্যকে দুঃখ দেবে না।
আয়ান ময়ূরের দেওয়া উপকরণ দিয়ে ঘুড়ি বানানো শুরু করল। তবে এবার সে শুধু বিক্রি করত না, বিনামূল্যে গরিব বাচ্চাদেরও দিত। তার ঘুড়ি এত সুন্দর আর মজবুত যে শহরের লোকজন হাকিম মিয়ার দোকান ছেড়ে ওর কাছেই আসত।
হাকিম মিয়া প্রথমে রেগে গেল। তারপর খবর পেল, একটা বাচ্চা ছেলের ঘুড়ি শহর জুড়ে বিখ্যাত হয়ে গেছে, আর সে পাহাড় থেকে বানিয়ে আনে ঘুড়ি। সবাই বলতে লাগল আয়ানের ঘুড়িগুলো যেন জাদুর ঘুড়ি। কী সুন্দর শাঁ শাঁ করে ওড়ে, আর বাতাসে মৃদু সুর ছড়িয়ে দেয়।
আয়ানের এত এত প্রশ্ন হাকিম মিয়ার ভালো লাগল না। সে একদিন নিজেই পাহাড়ে গিয়ে আয়ানের কাছে গেল। মুখে মিষ্টি হাসি, কিন্তু মনে ভরপুর হিংসা, তুই যে এত ঘুড়ির জিনিসপত্র পাইছস, সেই বক্সটা কোথা থেকে আসছে?
আয়ান সব সত্যি কথাই বলল, ময়ূরের কথা, বাক্সের কথা, আর তার প্রতিজ্ঞা কখনো কাউকে কষ্ট না দেওয়ার কথা।
হাকিম মিয়া মনে মনে ফন্দি আঁটল, হু, যদি আমি ওই ময়ূরের ঘাড় ধরে নিজের দোকানে নিয়ে যাই, তাহলে সে আমার ঘুড়ির কারখানার জন্য রোজ বাক্স আনবে!
পরদিন সে পাহাড়ে যায়। ছদ্মবেশে আয়ানের মতো একটা ঘুড়ি বানায়, ময়ূরের জন্য রাখে। ময়ূর এসে ঘুড়ি নেয়, আর ফেরত আসে একটা বাক্স নিয়ে। হাকিম মিয়া এবার ময়ূরটাকে খাঁচায় পুরে ফেলে, আর বাক্স নিয়ে বাড়ি ফেরে।
সে দিন শেষে দোকানের ভেতর বসে হাকিম মিয়া যখন বাক্স খোলে তখন তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়! ভেতরে ঘুড়ির জিনিস না, আছে শত শত কাগজের সাপ, ছায়া-মাকড়, ঝনঝনে তীক্ষè কাঁচ! একে একে সব উড়ে এসে তার দোকানের সব ঘুড়ি ছিঁড়ে ফেলে, দোকান তছনছ করে, আর তার গায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধে।
ময়ূর খাঁচার ভেতর থেকে চিৎকার করে ওঠে, ভালোবাসা কেউ চুরি করলে, সে পাবে কষ্টের প্রতিদান!
সেই রাতেই শহরে ঝড় ওঠে, দোকানের টিন উড়ে যায়, হাকিম মিয়ার নাম হয়ে যায় ‘সাপের ঘুড়িওয়ালা’!
আর আয়ান? সে এখন শিশুদের ঘুড়ির শিক্ষক। লোকে তাকে বলে জাদুর ঘুড়িওয়ালা। সে এখনো তার ময়ূর বন্ধুর জন্য প্রতিদিন একটা নতুন ঘুড়ি বানায়।