পুলিশ সপ্তাহ-২৫ সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এই নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় বৈঠক করে চলেছেন। আগামী ২৯ এপ্রিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অডিটরিয়ামে হবে পুলিশের সর্ববৃহৎ এ অনুষ্ঠান। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। ওইদিন বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পুলিশ ও রাষ্ট্রপতি পদক পরিয়ে দেবেন তিনি।
তবে পুলিশ ও রাষ্ট্রপতি পদক নিয়ে আগের মতোই জোরালো তদবির হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পদক পেতে অতিরিক্ত আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবলরা ইউনিট প্রধানসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাদের কাছে তদবির করেছেন। এরই মধ্যে পদক পাওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সাবেক আইজিপিসহ ৬২ জনের নাম গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তর অনুমোদন করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (কনফিডেন্সিয়াল) কামরুল আহসান স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে তালিকায় যারা চূড়ান্ত ২৭ এপ্রিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে তাদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছে।
এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজপি) বাহারুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নানা প্রতিকূলতার কারণে পুলিশ সপ্তাহ করতে সময় নেওয়া হয়েছে। ২৯ এপ্রিল পুলিশ সপ্তাহ শুরু হবে। যারা ভালো কাজ করবেন, তাদের পুরস্কৃত করা হবে। আগের মতো মুখ দেখে বা তদবিরে পদক দেওয়া হবে না। পদকের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হবে।
প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারও পুলিশ পদক পেতে নানা মহল থেকে তদবির এসেছে। বিশেষ করে একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও এসআইয়ের তদবির ছিল বেশি। এই নিয়ে আইজিপি ছিলেন অনেকটা ত্যক্তবিরক্ত। এবার তিনি চেয়েছিলেন তদবির যারা করবেন তাদের পদক দেবেন না। কিন্তু চাপের কাছে তিনিও পারেননি। অন্যবার ঢালাওভাবে পদক দেওয়া হয়েছিল। এবার পুলিশ সদর দপ্তর চেয়েছিল, ৩৫ থেকে ৪০ জনকে পুলিশ পদক দেওয়া হবে। কিন্তু তদবিরের কারণে তালিকা লম্বা করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চূড়ান্ত হওয়া তালিকার কেউ কেউ একাধিকবার পদক পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা পদক পেয়েছেন এবার পদকের তালিকায় তাদেরও নাম আছে। এই নিয়ে পুলিশের ক্ষোভ আছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে পদকের তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। বিগত পুলিশ সপ্তাহগুলোতেও তদবির করে অনেকের পদক ‘ছিনিয়ে’ নেওয়ার নজির রয়েছে। এ নিয়ে নানা সমালোচনার ঝড় উঠলেও কেউ বাদ যাননি। এবার পুলিশের প্রতিটি ইউনিট থেকে পদকের তালিকা চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে নাম এসেছিল। পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহে বিপিএম ও পিপিএম পদকপ্রাপ্তদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে ব্যাচ পরিয়ে দেন। তবে এবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদক পরিয়ে দেবেন। বিগত বছরগুলোর মতো এবার পদক ছিনিয়ে নেওয়া না হলেও তদবির ঠিকই হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখন অনেকেই নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন কিন্তু তারা পদক পাননি। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
পদকপ্রাপ্ত ৬২ জনের নাম চূড়ান্ত : সাবেক আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম, র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মো. আকরাম হোসেন, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মোসলেহ উদ্দিন আহমদ, অ্যাডিশনাল আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মো. ছিবগাত উল্লাহ, অ্যাডিশনাল আইজিপি (চলতি দায়িত্ব), মো. মাইনুল হাসান, উপ-মহাপরিদর্শক সরদার নুরুল আমিন, উপ-মহাপরিদর্শক কাজী মো. ফজলুল করিম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, জিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম, সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ রবিউল হোসেন ভূইয়া, অতিরিক্ত ডিআইজি আহম্মদ মুঈদ, পিবিআইর অতিরিক্ত ডিআইজি এনায়েত হোসেন মান্নান, খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল, ঢাকার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান, মাগুরার এসপি মিনা মাহমুদা, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু, পিবিআইর পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই খুদা, ৮ এপিবিএনের এসপি খন্দকার ফজলে রাব্বি, ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার রওনক আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম, এম, মোহাইমেনুর রশিদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল, নীলফামারীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. জুয়েল রানা, ডিএমপির সহকারী পুলিশ সুপার এম জে সোহেল, দোহার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-০১ এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. রাশেদুল ইসলাম বিশ্বাস, এপিবিএন উত্তরার পুলিশ পরিদর্শক গাজী গোলাম কিবরিয়া, পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাক আকন্দ, সিএমপির ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ ফজলুল কাদের চৌধুরী, কেএমপির ইন্সপেক্টর শফিকুল ইসলাম, আশুলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুল হক ডাবলু, আলমডাঙ্গার ওসি মুঃ মাসুদুর রহমান, সিরাজগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা শাখা পুলিশ পরিদর্শক মো. একরামুল হোসাইন, কাউনিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মোস্তফা কামাল, পাবনা জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই শ্রী বেনু রায়, গাজীপুর জেলা পিবিআইয়ের এসআই সুমন মিয়া, গোদাগাড়ী মডেল থানা এসআই বরুন কুমার সরকার, কুমিল্লা জেলা পিবিআইর এসআই ফিরোজ আহাম্মদ, হবিগঞ্জ জেলার এসআই মাহমুদুল হাসান, মির্জাগঞ্জ থানার এসআই এনামুল হক, সিএমপির সোয়াট টিম কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের এসআই রাছিব খান, পুলিশ সদর দপ্তরের এসআই রকিবুল হাসান, ঢাকা জেলা পিবিআইয়ের এসআই ইমরান আহমেদ, সিরাজগঞ্জ জেলা পিবিআইয়ের এসআই মো. আশিকুর রহমান, মুন্সীগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই ইয়াসিন, খাগড়াছড়ি থানার এসআই আজিমুল হক, ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চে এএসআই কামরুজ্জামান, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল নিযুক্ত এএসআই নাজমুল হুসাইন, ভাটারা থানা এএসআই মেসবাহ উদ্দিন, র্যাব-১৫ এর হাবিলদার মো. সাইফুল ইসলাম, সচিবালয় নিরাপত্তা বিভাগের কনস্টেবল মো. রুহুল আমিন ভূঞা, ঢাকা এটিইউর কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের কনস্টেবল মোহাম্মদ জোনাইদুল হক, ডিএমপির পরিবহন বিভাগের কনস্টেবল মোবারক হোসেন ও ডিএমপির পিওএম-পূর্ব বিভাগের কনস্টেবল রিয়াদ হোসেন।
বিশেষ দরবারে যেসব দাবি উত্থাপন : এবারের পুলিশ সপ্তাহে যে দাবিগুলো উত্থাপন করা হবে তা হলো স্বাধীন পুলিশ কমিশন, এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ভাতা, পুলিশের যানবাহন বৃদ্ধিকরণ, মৃতদেহের দাফন/সৎকারের সুবিধার্থে পুলিশের অনুকূলে আর্থিক বরাদ্দ প্রদান, পুলিশের অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট প্রতিষ্ঠা, পুলিশের বিভাগীয় হাসপাতালে জনবল বৃদ্ধি ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহসহ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারী পুলিশবান্ধব কর্মপরিবেশ বিনির্মাণ, ভূমিবিরোধ, বালু-জলমহাল ও হাটবাজার ইজারা এবং পরিবেশ আইন সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রতিরোধসহ বিবিধক্ষেত্রে সৃষ্ট আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ব্যয় সংকোচনের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক আইন/নীতিমালা থাকা প্রয়োজন, একই পদে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসরকালে সুপারনিউমারারি/অফিসিয়িটিং পদোন্নিত প্রদান (কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত), ডিজিটালাইজড পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তন ও পুলিশের দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নিয়োগের প্রচলন করতে হবে।
অন্যান্য বছরে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল, তার মধ্যে হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন বাতিল, গ্রেড-১-এর সংখ্যা আরও বাড়ানো, ডিআইজির পদ বাড়ানো, সুপার নিউমারারি পদ সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন আরও পুলিশ নিয়োগ, সব সদস্যের জন্য বিশেষ ভাতা চালু, পুলিশের জন্য আলাদা মেডিকেল কলেজ চালু, অ্যাভিয়েশন ইউনিট চালু, উন্নত অস্ত্রসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা, গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো, আবাসন সংকট সমাধানের প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা হবে। আরও কিছু নতুন দাবিও উত্থাপন করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানায়, অন্যবারের মতো এবার ঢাকঢোল পিটিয়ে জাঁকজমকভাবে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন করা হবে না। অনুষ্ঠান সূচিতে ব্যাপক কাটছাঁট করা হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে কুচকাওয়াজ (প্যারেড) হবে না। হবে না রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠক।