৪৩ বছরের হকি এশিয়া কাপের ইতিহাসে প্রথমবারে বাংলাদেশকে থাকতে হবে দর্শক হয়ে। ভারতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বসতে যাওয়া মর্যাদার আসরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ জাকার্তার এএইচএফ কাপের সেমিফাইনালে ওমানের কাছে হেরে। হকির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার দায় নিতে হবে সবাইকে।
গ্রুপ পর্বের খেলাগুলো দেখেই বাংলাদেশ হকি দল নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছিল না। তারপরও কেউ কল্পনা করেনি বাংলাদেশ ফাইনালের আগেই ছিটকে যাবে। মামুনুর রশীদের অধীনে দলটি গ্রুপের চার ম্যাচ জিতলেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে ঘাম ঝরাতে হয়েছিল অনেক। আগের চার আসরের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলেও অপর গ্রুপের ফেভারিট ওমান দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালে। যায় ফলে ওমানের সঙ্গে সেমিফাইনালে খেলতে হয় বাংলাদেশকে। ম্যাচের শুরু থেকেই ঝড়ো গতিতে বাংলাদেশ রক্ষণে হামলে পড়তে দেখা গেছে ওমানকে। সেই গতি পুরোটা বজায় রেখে জয় আদায় করে নেয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি।
বাংলাদেশের এমন ব্যর্থতার পর খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওমান এএইচএফ কাপ খেলার আগে দুই সপ্তাহ পাকিস্তানে ক্যাম্প করে এসেছে। সেখানে অনেকগুলো প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছিল তারা। কেবল ওমান নয়, ফাইনাল নিশ্চিত করা আরেক দল চীনা তাইপে, স্বাগতিক ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডও নিয়েছে ভালো প্রস্তুতি, খেলেছে অনেকগুলো করে প্রস্তুতি ম্যাচ। ব্যতিক্রম কেবল টুর্নামেন্টের ফেভারিট। ঘরের মাঠে মামুনের অধীনে কেবল অনুশীলনই করেছে, খেলেনি কোনো প্রস্তুতি ম্যাচ। আগের চার আসরে শিরোপা জেতায় এই আসরকে হয়তো দলের কোচ থেকে শুরু করে ফেডারেশন কর্তারা খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। তাছাড়া ফেডারেশনের এক অদ্ভুতুড়ে সিদ্ধান্তও এখন মনে হচ্ছে দলকে ব্যর্থতার দিকেই ঠেলে দিয়েছে। বিগত কমিটি ভেঙে সরকার হকি ফেডারেশনে বসিয়েছিল অ্যাডহক কমিটি। যারা দায়িত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ৩২ বছরের বেশি বয়সী কোনো খেলোয়াড়কে আর জাতীয় দলে সুযোগ দেবে না। অভিযোগ আছে, মোহামেডান অধিনায়ক রাসেল মাহমুদ জিমিকে শিক্ষা দিতেই এই সিদ্ধান্ত নেয় ফেডারেশন। অথচ ৩৭ বছরের জিমিকে কোনো অবস্থাতেই পারফরম্যান্সের কারণে বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বয়স হলেও নিজের ফিটনেস সেরা মানে রেখেছিলেন গেল দুই দশকে হকির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন জিমি। অথচ তাকে ফিটনেস টেস্টেই ডাকেনি ফেডারেশন। পরে দায়িত্ব নিয়ে জিমিকে দলে নেওয়ার পথে হাঁটেননি কোচ মামুনুর রশীদও। ফেডারেশন ও কোচের এমন সিদ্ধান্তকেই দলের ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সাবেক তারকা ও মোহামেডান দলের ম্যানেজার আরিফুল হক প্রিন্স। তিনি মনে করেন জিমিসহ বেশ কজন সিনিয়রকে সুযোগ না দিয়েই ছেঁটে ফেলার প্রভাবে বাংলাদেশের এই করুণ দশা, ‘দেশের চেয়ে ব্যক্তি ও ক্লাবের স্বার্থ যখন বড় হয়ে যায়, তখন তো এমনটা হবেই। জিমির মতো খেলোয়াড়কে ট্রায়ালেই ডাকেনি। এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, হয়েছে অনেক সমালোচনা। অথচ ফেডারেশন এসবকে গুরুত্বই দেয়নি। আর একজন দলকানা কোচকে দেওয়া হয়েছে দায়িত্ব। দল নির্বাচন সঠিক হয়নি বলেই এমন ব্যর্থতা। এর দায় কোচ ও ফেডারেশনকে নিতেই হবে।’
জাতীয় দলের সাবেক তারকা রফিকুল ইসলাম কামালও হতাশ হয়েছেন জাতীয় দলের খেলা দেখে। বন্ধু মামুনুর রশীদের অধীনে দলটিকে ভীষণ অসহায় লেগেছে তার কাছে, ‘বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ছিল। মামুনের কোচিংয়ে এমন খেলা কখনো দেখিনি। প্রস্তুতি ম্যাচের ঘাটতি শুরুর ম্যাচে প্রভাব পড়ার মতো ছিল। টুর্নামেন্টে চার ম্যাচ খেলার পর সেটা আর অজুহাত হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই।’
জাকার্তায় বসে বাংলাদেশের ভরাডুবি দেখেছেন সাবেক তারকা ও হকি ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পদাক সাজেদ এএ আদেল। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অ্যাপ্রোচ দেখে হতাশ হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি হকি ফেডারেশনের কর্তাদের অনভিজ্ঞও বলেছেন সাজেদ এএ আদেল, ‘খেলায় হারজিত থাকবেই। তবে বাংলাদেশ কাল (শুক্রবার) একেবারেই ভালো খেলেনি। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়েছে পেছন থেকে বোধ হয় টেনে ধরছে। জিমি থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। তবে একজন নেই বলে দল এত খারাপ খেলবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। ফেডারেশনের কমিটি গঠনের সময় বলা হয়েছিল যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা ভালো লোক। আমি বলব তারা ভালো লোক। তারা দীর্ঘদিন হকির সঙ্গে নেই। যারা হকির সঙ্গে আছেন, তাদের দিয়েই কমিটি করা উচিত ছিল। এখন দ্রুত নির্বাচন দিয়ে যোগ্য লোকের আসার ব্যবস্থা করা উচিত।’