মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

যুদ্ধ হবে না, এটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৩৫ এএম

কাশ্মীর ইস্যুতে এ অভিজ্ঞতা আমাদের সব সময়ের। সময়ে সময়ে চরম উত্তেজনার মুহূর্ত সামনে চলে আসে। যুদ্ধংদেহী মনোভাব চলে দুই দেশের মধ্যে। মনে হতে থাকে যে, এখনি বোধ হয় যুদ্ধ বেঁধে গেল; কিন্তু যুদ্ধ হয় না। এক্ষেত্রে ভারতই যুদ্ধংদেহী মনোভাব অনেক বেশি প্রদর্শন করে।

তবে এবার কাশ্মীর ইস্যুতে সিন্ধু নদীর পানিচুক্তি ও সিমলাচুক্তি স্থগিত করার মধ্য দিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে দুয়েকটা পদক্ষেপ খুব ক্ষতিকর হতে পারে আগামী দিনগুলোর জন্য। হয়ত দুয়েক দিনের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কেটে যাবে। তখন দুই দেশেরই ভাবনায় আসবে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো।

ভারত যে কাণ্ডটা করল সিন্ধু নদীর পানিচুক্তি স্থগিত করে দিল যেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। যদিও ভারত বলেছে, এ চুক্তিটা আবার ‘রিভাইজ’ করা উচিত। ভারতের পানি স্বল্পতার কারণে চুক্তিটা নতুন করে রিভাইজ করতে চায় তারা। প্রকৃতপক্ষে, এ চুক্তি বাতিল করার মানে ভারত আগ্রাসী ভূমিকা প্রদর্শন করেছে। পাকিস্তান এটাকে বলছে যুদ্ধ ঘোষণা। প্রকৃত অর্থেও তাই।

কেননা পাকিস্তানের ৯০ ভাগ কৃষিকাজ নির্বাহ হয় এ পানির ধারাবাহিকতায়। অর্থাৎ সিন্ধু নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তানের কৃষি। ৮০ ভাগ পানি পাকিস্তান এ চুক্তির মাধ্যমে পেয়ে থাকে। এটার গ্যারান্টিয়ার বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের মতামত না নিয়ে ভারত একতরফাভাবে যে কাণ্ডটা করল তাতে প্রতীয়মান হয় যে, আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ করেছে দেশটি। ১৯৬০ সালের পরে এটা কখনো ঘটেনি। ভারত পাকিস্তানের মৌলিক জায়গায় আঘাতটা হেনেছে। কারণ সিন্ধু নদীর পানিচুক্তি স্থগিত করে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর হাত দেওয়া হয়েছে। এটা হচ্ছে ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত বাস্তবতায় সাধারণ মানুষকে আঘাত করা। ভারতের এ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচুর সমালোচনা সৃষ্টি করবে। অপরদিকে পাকিস্তানও সিমলাচুক্তিকে স্থগিত করে দিয়েছে। এটাও অপ্রত্যাশিত ঘটনা। যদিও সিমলাচুক্তি ভারতকে সরাসরি অতখানি আঘাত করবে না।

পাকিস্তানের সিমলাচুক্তি প্রত্যাখ্যান করা মানে ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখাকে এখন পাকিস্তান অস্বীকার করবে। অগ্রাহ্য করবে। অর্থাৎ সিমলাচুক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান যে আচরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল সে আচরণ প্রক্রিয়া তারাও আর মানবে না। অর্থাৎ যেকোনো সময় পাকিস্তান এখন কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা পার হয়ে যদি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়, সেটা ভারতের জন্য একটা আঘাত হিসেবে আরও সামরিকীকরণের ধারণাকে শক্তিশালী করবে।

আমি মনে করি, এসবের পরেও বলা যেতে পারে বিশ্বব্যাপী দুদেশের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার ‘অ্যাটিচুড’ আসবে। যেখানে এখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশন বা সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে, শুধু মধ্যপ্রাচ্যকে বাদ দিয়ে ইসরায়েলের আচরণকে বাদ দিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, সমঝোতার ক্ষেত্রে যাচ্ছে। যুদ্ধকে অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ভারত-পাকিস্তানের এ ধরনের আচরণ অত্যন্ত অুীতমুখী, দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।

আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য যুদ্ধ অত্যন্ত বিব্রতকর। যেমন বাংলাদেশ— আমরা কী চাই? যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হোক। সার্ক ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তোলা হোক। সে পথে না গিয়ে ভারত-পাকিস্তান এখন আরও বেশি সম্পর্ক অবনতি ঘটানোর দিকে যাচ্ছে।

আমি মনে করি, পাকিস্তান আজাদ-কাশ্মীরের ব্যাপারে এখন আরও উদ্যোগী হয়ে যাবে। আগে কাশ্মীর ইস্যু স্তিমিত হয়েছিল। এখন আরও উদ্যোগী হবে। পাকিস্তানের অবস্থানটা অত্যন্ত বাস্তবধর্মী। কাশ্মীর ইস্যুতে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া হঠাৎ করে সব দোষ পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, পাকিস্তান নিজেই বিপর্যস্ত। কাশ্মীরের যে  গোষ্ঠীগুলোর কথা বলা হয়েছে, এগুলো তো পাকিস্তানে এখন কোনোভাবেই গ্রাহ্য করা হয় না। আর পাকিস্তানের একমাত্র সন্ত্রাসী সংগঠন হচ্ছে পিটিআই। প্রাক্তন তালেবান। যেটা সীমান্ত প্রদেশের। পাকিস্তান তো সীমান্ত প্রদেশের সব তালেবানকে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে। তাতে প্রমাণ হয় পাকিস্তান কোনোভাবেই পিটিআইপন্থি তালেবান সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে সহ্য করছে না। তাছাড়া পাকিস্তান নিজেই বার বার আক্রান্ত হচ্ছে। পাকিস্তান যেখানে নিজেই ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত।

দেশটি আন্তর্জাতিক একটা ভাবমূর্তি তৈরি করছে। পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে সেখানে একমাত্র দেশ ভারতই অংশগ্রহণ করেনি। অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রতি এখন বিশ্বের সব দেশেরই আস্থা রয়েছে। মোটামুটি দেশটি সন্ত্রাসী মোকাবিলা করেছে। সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। অথচ ভারত কিন্তু বার বার ক্রমাগত পাকিস্তানকে একটা দানবীয় ভাবমূর্তিতে রূপ দিতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কাশ্মীর ঘটনা না ঘটলেও ভারত একটা কিছু করত।

ভারতের ভেতরের অনেকেই বলছে— এটা না কি ভারতের সাজানো নাটক। এটা নাকি ভারত ইচ্ছে করে করেছে। ভারতে যে ওয়াকফ আইন (যেটা আপাতত স্থগিত) নিয়ে যে অস্থিরতা চলছে সেখান থেকে সেদেশের মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে কাশ্মীর ইস্যুকে উসকে দিচ্ছে ভারত। দেশটির সরকারদলীয় বিজিপি সমর্থকরা এ ধরনের কথায় নাচে।

এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সেখানে ইনোসেন্ট পরিবারের সদস্যরা-তারা কী দোষ করল? এখন সন্দেহ যা প্রমাণও হয় নাই, জাস্ট সন্দেহের বশে ছয়টা বাড়ি ভারতীয় বাহিনী সামরিক কায়দায় উড়িয়ে দিয়েছে। আসলে এখানে যুদ্ধও মোটেই হবে না। যুদ্ধ সন্নিকটেও নয়। এটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।

ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তিই শেষমেশ যুদ্ধ থেকে দুই দেশকে সরিয়ে নিয়ে আসে। পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলেই হঠাৎ করে আর যুদ্ধ হয় না। এর আগেও অনেকবার যুদ্ধের কাছাকাছি গিয়েছিল। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র ইক্যুয়েশনে যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে দুটি দেশকেই। পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ংকর হতে পারে, কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের বেলায় পারমাণবিক অস্ত্র একটা আশীর্বাদ বটে।

আশীর্বাদ বলা যায় এ অর্থে, তাদের আচরণগত দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করাটা অ্যাবস্যলুটলি বাধ্যতামূলক। ভারতও জানে যুদ্ধের মূল্য অনেক বেশি দিতে হবে। এর আগেও একবার ভারত চেষ্টা করেছিল কাশ্মীরে আঘাত করবে। পাকিস্তান একেবারে সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র বসিয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভারত সরে আসে। সুতরাং পাকিস্তান জানে এ পারমাণবিক অস্ত্র তাদের কাছে আছে বলেই ভারত কখনো আঘাত করবে না। পারমাণবিক অস্ত্র যদি না থাকতো তাহলে এ দুটি দেশ অনেক আগেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেত। অনেক বেশি ধ্বংস হয়ে যেত।

দুই দেশের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলবে। সেটা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা আবার স্তিমিত হয়ে যাবে। বাংলাদেশ চায়, সার্ককে উজ্জীবিত করতে। সার্কের মাধ্যমে যে কানেক্টিভিটি বাংলাদেশ ভারত যে যোগাযোগ, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিমান যোগাযোগ এগুলো সবই আরও পিছিয়ে যাবে।

ভারত-পাকিস্তান এ দুটি দেশ যে একে অপরকে হুমকি দিচ্ছে। ভারত অত্যন্ত আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। দেশটি এটাকে হিন্দু নিধনের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। এ পরিণতিতে বাংলাদেশকেও সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ মুসলমানপ্রধান দেশ এবং বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়ন ঘটছে। কাজেই বাংলাদেশকেও ভারত প্রচুর সন্দেহের চোখে দেখবে। আমাদের দেশকেও হয়ত ভারত ‘কম্যুনাল’ লাইনে চিন্তা করবে। মনে করবে পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশও একি। সুতরাং বাংলাদেশকেও সব সময়ে সতর্ক থাকতে হবে। কথাবার্তায় অধিকতর সচেতন থাকতে হবে।

লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত