ঝুঁকি কমাতে দাহ্য পদার্থে অতিরিক্ত মাশুল বসাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডের মধ্যে এখনো প্রায় ২০ বছর আগের রাসায়নিক পদার্থও রয়েছে। এসব রাসায়নিক পদার্থের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। গত বছর প্রায় ছয় কনটেইনার কার্গো জেটি থেকে অপসারণ করা হলেও এখনো বন্দরের বিভিন্ন শেডে প্রায় ৫০০ টন কেমিক্যাল এবং বিপজ্জনক পণ্যবাহী ৩০০ কনটেইনার রয়েছে। তাই নতুন দাহ্য পদার্থ দ্রুত ডেলিভারি না নিলে বাড়তি মাশুল আরোপের আইন করতে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ২১৮টি কনটেইনারে সালফিউরিক অ্যাসিডের পাশাপাশি সোডিয়াম ও পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো এসব রাসায়নিক পদার্থ দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে কনটেইনার ভেঙে বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। এগুলোর কারণে ঝুঁকি বাড়ছে বন্দরের। গত বছরের শেষের দিকে ছয়টি কনটেইনারে থাকা ১৪ বছরের পুরনো তরল রাসায়নিক পদার্থ বন্দরের ইয়ার্ড থেকে খালাস করা হলেও এখনো চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও ওভারফ্লো ইয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে ২১৮টি কনটেইনার রয়েছে। এসব কনটেইনারের অনেকগুলো ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। এদের কোনোটিতে পাউডারজাতীয় কেমিক্যাল, আবার কোনোটির গ্যালনের মধ্যে তরল রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। গ্যালনগুলো ভেঙে ভেতরে থাকা রাসায়নিক পদার্থগুলো বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও কনটেইনারের ওপরে গাছের চারা গজিয়েছে। ১৩৮তম বন্দর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে থাকা বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থগুলো সরিয়ে নিতে তিনি কাজ করছেন। এ লক্ষ্যে কাস্টমসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ চলছে। প্রকৃতপক্ষে কাস্টমস ছাড়া এসব পণ্য বের করা যায় না। তাই আমরা সমন্বিতভাবে বন্দরকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কাজ করছি।’
এদিকে বন্দর দিয়ে একটি দেশের পণ্য আনা-নেওয়া হয়ে থাকে এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য বিভিন্ন পণ্য এখানে অবস্থান করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বন্দর সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তবে আগামীতে যাতে কেউ রাসায়নিক পণ্য এনে বছরের পর বছর বন্দরে ফেলে রাখতে না পারে এবং বন্দরকে স্টোরেজ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য আমরা বাড়তি মাশুল হার রেখে আইন করছি। এতে কেউ বেশিদিন পণ্য রাখলে বাড়তি মাশুল দিতে হবে।’ তিনি বলেন, আমদানিকারক এগুলো খালাস করে নিয়ে যাবে দ্রুত। বন্দর তো আর তাদের পণ্যের স্টোরেজ হতে পারে না। এতে তো বন্দরের ঝুঁকিও বাড়ছে।
তবে স্বাভাবিক রাসায়নিক পণ্যগুলোর কারণে যাতে বন্দর ঝুঁকিমুক্ত থাকে, সেজন্য রাসায়নিক পণ্য রাখার শেডগুলো আধুনিকায়ন করা হয়েছে এবং এসব শেডে সব সময় আলো-বাতাস চলাচল করে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান।
অফডকে যাচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ : এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আগের ৩৮টি পণ্যের সঙ্গে এখন নতুন করে আরও ১২টি পণ্য অফডকে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ এখন থেকে এসব আমদানি পণ্য বন্দরের আসার সঙ্গে সঙ্গে অফডকে চলে যাবে। এদিকে এই ১২টি পণ্যের মধ্যে রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে চার ধরনের (ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ক্যালসিয়াম ফসফেট, মিথনাইল ও গ্লিসারেল)। রাসায়নিক পদার্থ আমদানিকারকদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ বিষয়ে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে সব অফডকে এসব রাসায়নিক পণ্য নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া যাবে না। শুধু যাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা রয়েছে, তাদের দিতে হবে।’ তবে যেহেতু চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে রাসায়নিক পণ্যের কারণে একবার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে, তাই অফডকে না দিয়ে বন্দর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জেটির বাইরে পৃথক কেমিক্যাল শেড করতে পারে বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম। তিনি বলেন, ‘বন্দর কারশেড ও অকশন শেডের মতো নিজেই একটি শেড করতে পারে।’
কিন্তু আমাদের অফডকগুলো রাসায়নিক পদার্থ রাখার মতো সক্ষম কি না জানতে চাইলে অফডক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) প্রেসিডেন্ট নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, ‘আমাদের সব ডিপোর ওই ধরনের সক্ষমতা নেই। তবে নতুন যেসব অফডক হচ্ছে, সেগুলোয় রাসায়নিক পদার্থ রাখার উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বছরের পর বছর রাসায়নিক পদার্থ ফেলে রেখে বন্দরের ঝুঁকি বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।
একই মন্তব্য করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, বন্দর দেশের সম্পদ। ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমদানি করা রাসায়নিক পদার্থগুলো বন্দরের বছরের পর বছর ফেলে রেখে বন্দরের ঝুঁকি বাড়াতে দেওয়া যাবে না। আমাদের এই আচরণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বন্দরের ভেতরে বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা রাসায়নিক পদার্থগুলো নিলামে বিক্রি বা ধ্বংস করার এখতিয়ার কাস্টমসের। কিন্তু তারা তা করছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে কাস্টমসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার সাকিব হোসাইন বলেন, ‘বন্দরের ভেতরে থাকা প্রায় ১৪ বছরের পুরনো প্রায় ছয় কনটেইনার রাসায়নিক পদার্থ আমরা গত বছরের শেষের দিকে ধ্বংস করেছি। বাকি যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলো কেমন ক্ষতিকারক, তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পরীক্ষা না করালে ক্ষতিকারক এসব রাসায়নিক পদার্থ যেখানে ধ্বংস করা হবে, সেই এলাকা আবার বিপর্যয়ে পড়তে পারে। তাই আমরা রাসায়নিক পদার্থগুলো পরীক্ষা করার কাজ করছি। পরীক্ষা শেষ হলেই সুরক্ষা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিশে^র অনেক বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুত বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণে ১০০ জনের মৃত্যু ও সাড়ে ৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছিল। এ ছাড়া গত শনিবার ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হরমুজগান প্রদেশের শহীদ রাজায়ী বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম বন্দরেও ২০২০ সালের দুই নম্বর জেটির কাছে তিন নম্বর শেডে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২২ সালের ১২ মে চার নম্বর গেটের কাছে একটি কনটেইনারে আগুন লেগেছিল।