উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকসের শীর্ষ কূটনীতিকরা গতকাল সোমবার একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরোতে দুদিনব্যাপী এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক বাণিজ্যনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শুল্ক মোকাবিলায় ঐকমত্যে পৌঁছানো। ব্রিকসের বর্তমান সভাপতি দেশ ব্রাজিলসহ, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বাণিজ্য জোটটির কূটনীতিকরা প্রথম দিনের আলোচনা সেরেছেন। চলতি সপ্তাহে ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করার প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকটি বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা জুলাইয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করবে।
হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তনের পর বিশ্ব জুড়ে অধিকাংশ দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধের শঙ্কা তৈরি হয়, ধস নামে শেয়ারবাজারে। যদিও পরে এই সম্পূরক শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তবে এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম চীন। দেশটির ওপর কয়েক দফায় শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করেন ট্রাম্প। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও ১২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে বেইজিং। ফলে বিশ্বের বৃহৎ দুই অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ এখন তুঙ্গে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্রিকসের এই সম্মেলনকে আর গুরুত্ববহ করে তুলেছে। সমন্বিতভাবে এই জোটের দেশগুলো বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা ও বৈশ্বিক মূল দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৯ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। ব্রাজিলের ব্রিকস প্রতিনিধি মরিসিও লিরিও শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, এই বৈঠকে একটি বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক ব্যবস্থার গুরুত্ব ও জোট সদস্যদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার বিষয়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীরা আলোচনা করবেন।
ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা এই বৈঠকের সভাপতিত্ব করন। তার সঙ্গে বৈঠকটিতে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইসহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা।
বৈঠকে ট্রাম্পের শুল্ক প্রভাব মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ও সমন্বিত পদক্ষেপ বিষয়ে আলোচনা করেন তারা। চলতি বছর নভেম্বরে ব্রাজিলের আমাজন শহর বেলেমে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের (কপ-৩০)- প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। শপথ গ্রহণের পর থেকেই ট্রাম্প রাশিয়া এবং ইউক্রেনকে একটি শান্তি চুক্তির দিকে ধাবিত করতে চাচ্ছেন। এরই মধ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা চালিয়ে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে দুই দেশ পরোক্ষ ও মৌখিকভাবে যুদ্ধ অবসানের ইঙ্গিত দিলেও, কার্যত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আজ মঙ্গলবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অন্য ৯টি সঙ্গী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা যোগ দেবেন। এসব দেশের মধ্যে আছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন জোটের কয়েকটি দেশ, কিউবা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, উগান্ডা ও নাইজেরিয়া।
২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর এই জোটের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন পাঁচ সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে পরে এই জোটে যুক্ত হয়েছে ইরান, মিসর, ইথিওপিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ফিরেই ব্রিকসকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছিলেন, ব্রিকস দেশগুলো যদি ডলারের বিরুদ্ধে পাল্টা মুদ্রাব্যবস্থা চালু করে, তবে তাদের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে বৈশি^ক শাসন সংস্কার ও সহযোগিতা প্রচারের দিকে মনোনিবেশ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিকস। চলতি বছর ৬-৭ জুলাই ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জোটটির শীর্ষ সম্মেলন হবে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ব্রিকসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে ব্রাজিল। বর্তমান সদস্যরাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি সৌদি আরবকেও এতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তুরস্ক, আজারবাইজান এবং মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় এই জোট বৈশি^ক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
