প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাতার সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ পেল না, বরং বৈশ্বিক অঙ্গনেও নিজেদের উন্নয়ন, সংস্কার ও তরুণ নেতৃত্বের ভাবনা নতুন করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হলো।
প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফর নিয়ে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। এ সফর বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করেছে বলে অভিমত তাদের। অবশ্য কূটনৈতিক সূত্রগুলো সফরে কিছু প্রটোকলগত ঘাটতির বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কাতারের রাজধানী দোহা ও ভ্যাটিকান সিটিতে সপ্তাহব্যাপী সরকারি সফর শেষে গতকাল সোমবার দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এ দুটি দেশে সফরকালে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্ট ও উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন।
কূটনৈতিক অগ্রগতি
ড. ইউনূসের সফরের অন্যতম সাফল্য ছিল কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানির সঙ্গে সরাসরি বৈঠক। এই বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা এবং তরুণসমাজের ভূমিকার বিষয়ে আলোচনা করেন। সফরে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ছিল— বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে কাতার একজন বিশেষ উপদেষ্টা নিয়োগ করবে। এ উদ্যোগ ভবিষ্যতে দুদেশের মধ্যকার যোগাযোগ, বিনিয়োগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরও সুসংহত করবে।
এ ছাড়া আর্থনা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে ড. ইউনূস বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক ব্যবসার প্রসার এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য তরুণ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তার বক্তব্য কাতারসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
ড. ইউনূসের কাতার সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বিনিয়োগ ও বাণিজ্য খাতে সম্ভাবনা তৈরি। বিনিয়োগ আকর্ষণে তিনি কাতারের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালার কথা তুলে ধরেন। এতে আগামী দিনে বাংলাদেশে কাতারি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ার আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে।
সফরের মাধ্যমে চারজন নারী ক্রীড়াবিদের জন্য কাতার ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও সুযোগ নিশ্চিত করেছে, যা ক্রীড়া খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
বিশেষভাবে প্রশংসাযোগ্য ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে তার মতবিনিময়। দোহায় অনুষ্ঠিত এই সভায় তিনি প্রবাসীদের সমস্যা শোনেন এবং তাদের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক পরিসরে প্রবাসীদের ভূমিকা নতুন করে গুরুত্ব পায়। দোহায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরও গতিশীল করার অঙ্গীকার করা হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ড. ইউনূসের সফরের আরেকটি বড় অর্জন ছিল বাংলাদেশের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশকে কাতারের ব্যবসায়ী সমাজের সামনে তুলে ধরা। বৈঠকগুলোয় তিনি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে সরাসরি আলোচনা করেন। এতে ভবিষ্যতে কাতার থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. তাহমিনা রশিদ বলেন, ‘ড. ইউনূসের সফরটি ছিল বাংলাদেশের জন্য স্ট্র্যাটেজিক মোমেন্টাম তৈরির সুযোগ। বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিবর্তনের এ সময় কাতারের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হবে।’
অর্থনীতিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানোর জন্য এ সফর বড় একটি ভিত্তি তৈরি করল। এখন সরকারের উচিত দ্রুত বিনিয়োগ সুবিধা নিশ্চিত করা।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ড. ইউনূসের এ সফরে দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার একটা দ্বার উন্মোচিত হলো। তাদের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের শ্রমবাজার রয়েছে। এখন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন দিক তৈরি হয়েছে।’
সম্ভাব্য বিনিয়োগ চুক্তির তালিকা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাতার সফরের আলোচনায় যেসব খাতে বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে, সেগুলো হলো—
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত: কাতারের জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সৌরশক্তি ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখবে।
অবকাঠামো উন্নয়ন খাত: কাতার বাংলাদেশের অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চায়। এতে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের সম্প্রসারণ, নতুন মহাসড়ক নির্মাণ, রেললাইন আধুনিকায়ন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
অর্থনীতিবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি। চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের সম্প্রসারণ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের লজিস্টিক কেন্দ্র হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
স্বাস্থ্যসেবা খাত: কাতারের স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রবাসী ও স্থানীয় জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা রয়েছে, যা বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেবে। মেডিকেল টুরিজম খাতের সম্ভাবনাও বাড়বে।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাত: বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাতারের কিছু প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে চায়। এতে উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হবে।
প্রযুক্তি ও স্টার্টআপ খাত: ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কাতার বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সেন্টার ও বিশেষায়িত ফান্ড গঠনে আগ্রহ দেখিয়েছে। এর ফলে দেশে প্রযুক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতে পারে। যেখানে বিশ্বজুড়ে রয়েছে তরুণ উদ্যোক্তাদের বিশাল গোষ্ঠী। কম খরচে প্রযুক্তি খাতে কাজ করার পরিবেশ, বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের যেমন আকর্ষণ করবে, তেমনি দেশীয় ক্ষেত্রে নতুন সাড়া জাগাবে।
বাংলাদেশ-কাতার সম্পর্ক: বাংলাদেশ ও কাতারের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উষ্ণ ও অংশীদারত্বপূর্ণ। ১৯৭৮ সালে কাতারে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলার পর থেকে দুদেশের মধ্যে শ্রমবাজার, জ্বালানি, শিক্ষা এবং বিনিয়োগ খাতে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
শ্রমবাজার: বর্তমানে ৪ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক কাতারে কর্মরত, যারা বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের একটি বড় অংশ সরবরাহ করেন।
জ্বালানি ও জ্বালানি নিরাপত্তা: কাতার বাংলাদেশের এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহের অন্যতম প্রধান দেশ।
বিনিয়োগ: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কাতারি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অবকাঠামো, শক্তি ও রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তবে এতদিন এই সম্পর্ক প্রধানত শ্রম ও গ্যাস সরবরাহকেন্দ্রিক ছিল। ড. ইউনূসের সফর নতুন করে এই সম্পর্ককে বহুমাত্রিক করার পথ খুলেছে— যেখানে তরুণ নেতৃত্ব, সামাজিক ব্যবসা এবং টেকসই উন্নয়নকেও অংশীদারত্বের কেন্দ্রে আনা হচ্ছে।
২২ এপ্রিল আর্থনা সম্মেলন ২০২৫-এ অংশ নেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি ‘সোশ্যাল বিজনেস ফর এই সাসটেইনেবল ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক সেশনে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বিশ্ব সম্প্রদায়কে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং দারিদ্র্যদূরীকরণের আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। সম্মেলনে তিনি তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশ এবং শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্বের ধারণা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেন।
বক্তব্যদানকালে তিনি বলেন, ‘যুবসমাজই টেকসই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে আমরা দারিদ্র্য, কার্বন নিঃসরণ ও বৈষম্য শূন্য করতে পারব’ বলে প্রধান উপদেষ্টা সংকল্প ব্যক্ত করেন।