বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের তিন দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিতে গিয়ে মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বিমানকে দিতে এসেছি, কিছু নিতে আসিনি।’ ওইদিনের মতবিনিময় সভায় বক্তারা তাকে বিমানের ‘কিংবদন্তি’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সেই কিংবদন্তি কী সংস্কার করেছেন জানতে চাইলে বিমানের এক পরিচালক স্মৃতি হাতড়ে কিছুই পেলেন না। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কার তো দেখি না। সব আগের নিয়মেই চলছে। যাওবা একটু করেছেন, জনপ্রশাসনের জন্য করেছেন; বিমানের জন্য কিছু করেননি।’ অথচ বিমানের জন্যই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরে তাকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জনপ্রশাসনের জন্য একখানা সুপারিশ করলেও, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।
মুয়ীদ চৌধুরী বিমানের জন্য কী করতে পারতেন জানতে চাইলে একজন পাইলট বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা সফল হয়েছে বলেই এ বয়সে মুয়ীদ চৌধুরী আবার জাতির সামনে হাজির হতে পেরেছেন। সবাই তাকে ভুলেই গিয়েছিল। তার সামনে সুযোগ ছিল পাইলট নিয়োগের বৈষম্য দূর করার। সাধারণ মানুষের সন্তান পাইলট হতে পারে না। যারা পাইলট তাদের সন্তানরাই ঘুরেফিরে পাইলট হচ্ছে। অথবা যাদের পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা আছে তারা পাইলট হচ্ছে। অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তোড়ে যখন সরকার ভেসে গিয়েছিল তখন ভেবেছিলাম যাক, এবার মনে হয় পাইলট নিয়োগে বৈষম্য দূর হবে। যোগ্যতা থাকলে পাড়াগাঁয়েরও কেউ পাইলট হওয়ার স্বপ্নপূরণ করতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো কই! মুয়ীদ চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পরই এক দফা পাইলট নিয়োগ হলো। সেই পুরনো কায়দায়। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি পাইলট নিয়োগে যেন স্বচ্ছতা আনা যায়। আমরা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছি এবং দফায় দফায় বলেছি। কিন্তু বলা পর্যন্তই। আমাদের সব চেষ্টাই বৃথা।’
বিমানে জনবল নিয়োগে কিছু খুচরো অনিয়ম হয়। বছর জুড়েই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় আর সারা বছরই সেসব পদে নিয়োগ চলতে থাকে। কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামো না থাকায় অনিয়মের পথ সুগম হয়। বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে কাজ হয়েছে। কী কারণে যেন তা অদৃশ্য শক্তির ইশারায় আটকে যায়। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিমানে সংস্কারের প্রস্তাব করেছিল, যদিও তা কাজে আসেনি। ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। এর আগে বিমানের অনুমোদিত জনবল ছিল ৬ হাজার ৮৩৭ জন। কোম্পানি করার সময় সরকার জনবল ৩ হাজার ৪০০ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য ১ হাজার ৮৭৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘স্বেচ্ছা’ অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। তাদের বিদায় করার মতো টাকা বিমানের ছিল না। সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ওই কর্মীদের ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিমের আওতায় অবসরে পাঠায়।
পরে আরও জনবল নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিয়োগ দিতে পারলেই টাকা। আর দলীয় কর্মীদের চাকরি দেওয়ার বিষয় তো রয়েছেই। ফলে নতুন সাংগঠনিক কাঠামো করার জন্য কমিটির পর কমিটি করা হয়। এ ফাঁকে কর্মী নিয়োগও চলতে থাকে। বিমানে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা স্বাভাবিক বিষয়। আর একজনের পরীক্ষা আরেকজনের দেওয়ার ঘটনাও স্বাভাবিক। এসব বিষয়ে অনেক মামলা চলমান রয়েছে, যার জেরে কর্মীদের জেলেও যেতে হয়েছে।
২০০৯ সালে কাঠামো পুনর্গঠনের প্রথম কমিটি ৬ হাজার ৭০৫ জনবলের প্রস্তাব করে, যা তৎকালীন বোর্ড গ্রহণ করেনি। পরে সেই বোর্ড আরনেস্ট অ্যান্ড ইয়াং নামের এক ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে কাঠামো তৈরির দায়িত্ব দেয়। ওই প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৪৭৮ জনের জনবল কাঠামোর প্রস্তাবসহ রিপোর্ট দেয়। ওই প্রস্তাবও মনঃপূত হয়নি বোর্ডের। পরে ২০১৪ সালে ১২৪তম বোর্ড সভায় নতুন কাঠামোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় বোর্ডের সদস্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব (পরে মুখ্য সচিব) আবুল কালাম আজাদকে। তার নেতৃত্বে ‘অন অর্গানাইজেশন, এস্টাবলিস্টমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিস রুলস’ নামের একটি সাব-কমিটি করা হয়। সাব-কমিটি ৪ হাজার ২৪৩ জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করে। ২০১৫ সালে বিমানে কাইল হেইউডকে এমডি নিয়োগ করা হলে আবুল কালাম আজাদকে জনবল কাঠামো করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ৪ হাজার ৫৭৫ জনবলের প্রস্তাব করেন। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের নেতৃত্বে পুনরায় একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। এরপর দফায় দফায় আরও কমিটি ও সাব-কমিটি হলেও সাংগঠনিক কাঠামো হয়নি। জনবল কাঠামো ও সার্ভিস রেগুলেশন তৈরির নামে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অনুকূলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। অফিস আদেশের মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামো হয়েছে, ব্যক্তিগত স্বার্থে বদলও হয়েছে।
কার্যকরী সাংগঠনিক কাঠামো না থাকায় যখন-তখন নিয়োগ দেওয়া যায়। একই পদে নিয়োগে একেক সময় একেক শর্ত দেওয়া হয়। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, যা নিয়ে কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা রয়েছে।
বিমানে ক্যাজুয়াল, চুক্তিভিত্তিক ও স্থায়ী নামের জনবল রয়েছে। বেতন বিভাগের কর্মচারীর সংখ্যাই কয়েক হাজার বলে জানা গেছে। চাকরি শেষে কর্মীদের কেউ পান পেনশন, কেউ পান গ্র্যাচুইটি, কেউবা খালি হাতে বাড়ি ফেরেন। বর্তমানে মোট কর্মীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।
বিমান পরিচালিত হয় প্রশাসনিক আদেশে। এসব আদেশই বৈষম্য তৈরি করেছে। অনেক আদেশ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিককে অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে অধিকাল ভাতা (ওভারটাইম) দেওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক আদেশে তাদের ‘কলড অন’ ভাতা দেওয়া হয়।
সংস্থাটিতে পদোন্নতির অনিয়মেরও অভিযোগ রয়েছে। পদোন্নতির পথ বাতলে দেয় ওএন্ডএম শাখা। কথা চালু রয়েছে, এ শাখার কর্তাব্যক্তিরা অঢেল সম্পদের মালিক। পদোন্নতি থেকে নানা ছুতোয় যোগ্যদের বাদ দেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও সাক্ষাৎকার না নিয়েই পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বদলিজনিত কারণে পদ শূন্য করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কাক্সিক্ষত ব্যক্তির পদোন্নতি নিশ্চিত করার পর যাকে বদলি করা হয়েছে তাকে আবার আগের পদে ফিরিয়ে আনা হয়। সাংগঠনিক কাঠামোতে একটি পদ থাকলেও ওই পদে তিন-চারজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। চাকরি শুরুর পদেই (এন্ট্রি লেভেলে) পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তাছাড়া কাজ করানো হয় এক জায়গায়, কাগজপত্রে দেখানো হয় অন্য জায়গায়। নিজস্ব লোকদের চুক্তিভিত্তিক পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ দেওয়া হয় এক পদে, কাজ করানো হয় অন্য পদে। নিয়োগের সার্কুলার এক পদে, যোগদান হয় ভিন্ন পদে। এমন আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদই বিমানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছে। এরপরও বিমানের কাজ সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল না। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে বিমানের কোনো জবাবদিহি নেই। বিমানের এমডিরা নিজেদের মন্ত্রীর সমপর্যায়ের ভাবেন। মন্ত্রীর সঙ্গে টক্কর দেন। পেছন থেকে রাজনৈতিক শক্তি এমডিদের তাল দেয়। বিমানকে আবার করপোরেশন করার একটি ভাবনা বিমানসংশ্লিষ্টদের মধ্যে রয়েছে। তা না করা গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে পরিচালনা পর্যদের ক্ষমতা বা কার্যপরিধি ঠিক করার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। এ কমিটি বিমান পরিচালনা পর্ষদ, বেবিচক ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করবে।
রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটির এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়া নিয়েও বিস্তর অভিযোগ। সংসদীয় কমিটি দিনের পর দিন পার করেছে লিজের অনিয়ম নিয়ে। মুয়ীদ চৌধুরী চেয়ারম্যান হয়ে আসার পর নতুন এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়া হয়নি। তবু লিজের বিষয়টি আলোচনায় আছে।
বিমানের রয়েছে ৯টি সংগঠন। সিবিএ’র নেতৃত্বে রয়েছে বিমান শ্রমিক লীগ। এ ছাড়া রয়েছে বাংলাদেশ বিমান এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, বাংলাদেশ বিমান শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ বিমান ফ্লাইং সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব কেবিন ক্রু, সোসাইটি অব এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার্স অব বিমান, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন, বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বিমান বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নিবন্ধন নেই, তবু তাদের দাপট আছে। সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি না করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিটি সুপারিশ করেছে। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারতেন মুয়ীদ চৌধুরী।
কথা বলার জন্য দফায় দফায় তিনিসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী গত ২১ আগস্ট বিমানের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন। বিমানের সার্বিক কার্যক্রম একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওযার বিধান রয়েছে। এরপর তিনি এমডি নিয়োগ করেন সফিকুর রহমানকে। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা বাধা দিয়েছিলেন তাদের নিয়েই বিমান চালাচ্ছেন। সফিকুর রহমানকে ফিরিয়ে এনে প্রশাসন ক্যাডারের কবজা থেকে এমডি ও সিইও পদটিকে রক্ষা করেছেন তিনি।
প্রথম দিনের মতবিনিময় সভায় মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, বিমান পরিচালনা পর্ষদকে সংস্কার করে পুনর্গঠন করা হবে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, মতিঝিলে ও ফার্মগেটে হাইরাইজ ভবন নির্মাণ, দক্ষ জনবল বাড়ানো, বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো, এয়ারপোর্টে যাত্রীদের সেবার মান বাড়ানো এবং বিমানের টিকিট যেন সর্বসাধারণের কাছে সহজলভ্য হয়, সেসবের জন্য কাজ করতে চান তিনি। কিন্তু কোনোটিই কাক্সিক্ষত মানে নিতে পারেননি ‘কিংবদন্তি’।