বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বিএনপির কাছে নির্বাচনই মুখ্য?

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৪ এএম

আসলে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচন চায়। কিন্তু এ বিষয়ে বিএনপির নাম, সংগত কারণেই বেশি রটেছে। কারণ দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিএনপি সবসময়ই সরব এবং উচ্চকণ্ঠ। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগেই নয়াপল্টনে ৭ আগস্টের সভায় বিএনপি মহাসচিব ভবিষ্যতের অন্তর্বর্তী সরকারকে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে তাগিদ দেন। একই সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান জুলাই বিপ্লবের বিজয়কে চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। সেদিনের সেই বক্তৃতায় তিনি ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে’ কথাটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পর পর দুবার উচ্চারণ করেন। যা থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির ব্যাপারে বিএনপি সোচ্চার ছিল।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপি মুখর হবে এটাই স্বাভাবিক। গত ১৫ বছর ধরে দেশে প্রকৃত অর্থে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। তারপরও দেশের জনগণ আশা করে ছিল, বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে যতটা সক্রিয়, ঠিক ততটাই বা তার চেয়ে বেশি সোচ্চার হবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার, ফ্যাসিস্ট সরকারের অপকর্ম উদঘাটন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার, বিগত ১৫ বছরের গুম-খুনের বিচার, জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়ে। সেই সঙ্গে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যেও পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ৫ আগস্টের পরপর শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের নিরপত্তা বিধান এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে, বাড়ানো সহযোগিতার হাত কিছুদিন পরেই ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিতে থাকে। শুধু বিএনপি নয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের স্থিতিশীলতা রক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র ছাত্রদের। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপিও দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একের পর এক ফ্যাসিস্টের নানাবিধ অপচেষ্টা রুখে দিতে দলগতভাবে আগের মতো সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসেনি। যার মাধ্যমে ওইসব অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার সক্রিয় দায়িত্বটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলে দেয় দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে সেই সময়কার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সবার আগে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ফলে একসময় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আর আগের মতো সক্ষম নয়’ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রচারিত এই বয়ান সত্য প্রমাণিত হতে থাকে। বিএনপিসহ অন্য দলগুলো যে এটাই চাচ্ছিল তাও বোঝা যায় সে সময়কার অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যে। রাষ্ট্রপতির অপসারণ, জুলাইয়ের প্রোক্লেমেশন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষেধ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজনৈতিক দল সম্মত না হওয়ার মাধ্যমে সেটা সহজেই বোঝা যায়। যদিও তার মধ্য দিয়েই নিষিদ্ধ হয়ে যায় ছাত্রলীগ এবং ধ্বংস করা হয় ছাত্রদের কাছে ফ্যাসিস্টের আইকনিক স্থাপনা বলে পরিচিত ৩২ নম্বর। এই ঘটনায় বিএনপির কোনো সমর্থন ছিল না।

অথচ ইতিমধ্যে অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে বিএনপির দায়িত্বশীল, গ্রহণযোগ্য নেতারাও প্রকাশ্যে টক-শোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে নানাবিধ বিতর্কে জড়াতে থাকে। অযাচিত এই বিতর্ক জনগণ ভালোভাবে নেয়নি বলেই মনে হয়। এ কথা সবারই মনে থাকার কথা যে, জেনারেল ওয়াকার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে এক ধরনের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। তার এই বক্তব্যের পর বিএনপিও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ক্রমশ আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকে। অন্যদিকে জনসাধারণের পক্ষ থেকে সংস্কার, ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার মাফিয়া বাহিনীর বিচার, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি যখন ঘনীভূত হতে থাকে, বিএনপি তখনো মূলত ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে একমাত্র অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করাতে থাকে এবং তাদের এই প্রচেষ্টা খুবই সফল হয়। একপর্যায়ে নির্বাচন প্রসঙ্গ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় যে, নির্বাচন এবং সংস্কার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে এটাই প্রতিভাত হতে থাকে যে, বিএনপি সংস্কার চায় না। যদিও বিএনপির অনেক নেতা বলতে শুরু করেছেন যে, তারা সংস্কার চান না এটা তারা বলেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ মনে করে বিএনপি সংস্কার চায় না, নির্বাচন চায়। এর পেছনেও কারণ আছে। বিএনপির বড় নেতা মির্জা আব্বাস যখন বলেন, ওদের কলমের সংস্কার আমরা সহজে মেনে নেব না, সংস্কার যদি করে আমরা কারেকশন করব। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশ সঠিক পথে থাকবে না বলে নানা রকম জোরালো বক্তব্য রাখতে থাকেন আমীর খসরু মাহমুদ কিংবা বিএনপি রাস্তায় নামার আগেই নির্বাচন দিন, নইলে হাসিনার দিকে তাকান বলে বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদু হুমকি দেন, নির্বাচন কীভাবে আদায় করে নিতে হয় বিএনপি তা জানে, এমন সব অনেক অনেক বক্তব্য যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায়, তখন এ নিয়ে আর সাধারণের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে অযাচিতভাবে ভারত যখন তাগাদা দিতে থাকে বিএনপি তখন যেন নির্বাচনের দাবি নিয়ে আর বেশি সরব এবং যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দল যারা প্রথমে সংস্কার চাচ্ছে তাদের সমালোচনা শোনা যায় বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতার বক্তব্যে। অনেকেরই হয়তো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের একটা বক্তব্য মনে থাকার কথা। তিনি এক ভার্চুয়াল সভায় বলেছেন, যারা বলছেন আগে সংস্কার পরে নির্বাচন, তাদের ক্ষেত্রে আমরা কী দেখছি? মুখে বলছে তারা পরে নির্বাচন কিন্তু তারা তো দেখছি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রার্থী ডিক্লেয়ার করছেন। তিনি আরও বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া এ কথা ঠিক কিন্তু চলমান সেই প্রক্রিয়াকে এর আগে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছে দেশের জনগণ।

বিবিসির এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘দালিলিক ভিত্তি’ ছিল আন্দোলনরত তিন জোটের ঘোষিত রূপরেখা। তখনকার আন্দোলনকারী ও বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিল ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি-রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল’, যা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি। নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখা শেষমেশ বাস্তবায়িত হয়নি। জনগণ বারবার সেই উদাহরণকে সামনে এনে, রাজনৈতিক দলের আশ্বাসে আপাতত তাদের আস্থা নেই সেই কথাটাই বলে যাচ্ছে। নগদ পাচ্ছে তাই নিতে চাচ্ছে এদেশের জনগণ। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের মন্তব্যের উত্তরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি  নেই, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আর প্রস্তুতিই যদি না থাকে তাহলে তারা ডিসেম্বরে কীভাবে নির্বাচন করবেন?

বিএনপির দাবি, ২০২৩ সালে তারেক রহমানের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার মধ্যেই সংস্কারের কথা আছে। কথা শতভাগ সত্য। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার মধ্যে প্রথম ৫টি দফার কথা উল্লেখ করতেই হয়। ১. জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন। ২. সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্রসত্তা (জধরহনড়-িঘধঃরড়হ) ও ‘জাতীয় সমন্বয় কমিশন (‘ঘধঃরড়হধষ জবপড়হপরষরধঃরড়হ পড়সসরংংরড়হ’) গঠন। ৩. অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনকালে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। ৪. আইনসভা, মন্ত্রিসভা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা। ৫.  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা অনূর্ধ্ব পরপর দুই মেয়াদ নির্ধারণ। ৬. বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন। এই ৫ দফার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত সংস্কারের যথেষ্ট মিল আছে। অথচ বিএনপি সেই সংস্কার মানছে না। তারা বলছে, আমরা সংস্কার চাই, আমরাই প্রথম সংস্কারের কথা বলেছি। তাহলে বর্তমান সংস্কার মানতে অসুবিধা কোথায়? বিএনপি তাদের ৩১ দফার অনেকগুলোই তো এখন চাইলে আদায় করে নিতে পারে। কিন্তু তারা সেটি না করে স্ববিরোধী আচরণ করছে। যার একটা উদাহরণ হচ্ছে, দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, সেই প্রস্তাবের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। যদিও এটি তাদের ৩১ দফার অন্যতম প্রশংসিত দাবি। এখন তারা সেই দাবিটিকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উপস্থাপন করছে। এ প্রসঙ্গে এই সময়ের আলোচিত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমাদের প্রস্তাব যেটা, সেটা হচ্ছে যে, ‘নট মোর দেন দু কন্সিকিউটিভ টার্মস’, অর্থাৎ পরপর দুবারের বেশি কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যদি দুবারের পর একবার গ্যাপ (বিরতি) হয়, তার পরবর্তী সময়ে যদি জনগণ নির্বাচন করে সেই পার্টিকে মেজরিটি পার্টি (সংখ্যাগরিষ্ঠের দল) হিসেবে; সেই পার্টি যদি ডিসাইড (সিদ্ধান্ত গ্রহণ) করে, তাহলে সেই একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতেও পারেন।” তিনি আরও বলেন, “কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন ধরে নিচ্ছেন যে, সেম লিডার (একই নেতা) বা ব্যক্তি বারবার হবেন। আমরা তো এখানে অপশনটা (সুযোগ) রাখতে চাই যে, বাধ্যবাধকতা করা যাবে না।” তার মানে হচ্ছে, তাদের ৩১ দফার বিশ্লেষণ প্রয়োজন তা না হলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ আছে। বিষয়টা এমন নয় যে, নির্বাচন নিয়ে কথা না বললে, নির্বাচন আসবে না! নির্বাচন তো আসতেই হবে। তবে সংস্কারবিহীন নির্বাচন।

লেখক: সাংবাদিক ও চিকিৎসক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত