১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিমান ডানা মেলার পর থেকে প্রায় প্রতি অর্থবছর লোকসান দিচ্ছে। এয়ারক্রাফট, পাইলট সংকট এবং নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি এ সংস্থার মূল সমস্যা। এমনটিই চলছে দীর্ঘ বছর। অথচ সেটি হওয়ার কথা ছিল না। বিমানের এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা নেই। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট বহু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানে এসেছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে বলেছেন অনেক মন ভালো করা কথা। তখন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুশিতে গদগদ হয়েছেন। তারা ভেবেছেন এই তো, এবার আমাদের সব সমস্যা দূর হবে। কিন্তু সকলি গরল ভেল। কিছুই হয়নি। উল্টো কেউ হয়ে গেছেন ‘কিংবদন্তি’! বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের তিন দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিতে গিয়ে সাবেক সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বিমানকে দিতে এসেছি, কিছু নিতে আসিনি।’ ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। ওইদিনের মতবিনিময় সভায় বক্তারা তাকে বিমানের ‘কিংবদন্তি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, বিমানের অজস্র সমস্যার সমাধান হয়তো এবার হবে। পাইলট নিয়োগে কোনো বৈষম্য থাকবে না। যেকোনো নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকবে। জনবল সংকট দূর হবে। পদোন্নতিতে কোনো চেনামুখ থাকবে না। পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। এর মানে হচ্ছে যথা পূর্বং, তথা পরং (আগে যা ছিল, পরেও তাই)।
বাংলা ভাষায় বিশেষণ ঢের। আমরা কথায় কথায় একজনকে বলি, ক্ষণজন্মা। অথচ এই ক্ষণজন্মার ব্যাসবাক্য হচ্ছে ‘শুভক্ষণে জন্ম যার’। কিন্তু আমরা কি ভেবে বলি? ঠিক এভাবেই বলি কিংবদন্তি। এই শব্দের মানে কী? এর সঙ্গে আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর কর্মকা- কতটুকু মেলে? সেই কিংবদন্তি কী সংস্কার করেছেন জানতে চাইলে বিমানের এক পরিচালক বলেন, ‘সংস্কার তো দেখি না। সব আগের নিয়মে চলছে। যাওবা একটু করেছেন তা জনপ্রশাসনের জন্য। বিমানের জন্য কিছু করেননি।’ অথচ বিমানের জন্যই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরে তাকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জনপ্রশাসনের জন্য একটি সুপারিশ করলেও তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে বর্তমানে আন্তর্জাতিক রুটে দিনে বিমানের সর্বোচ্চ ২৭টির বেশি সøট পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ‘টিকিট নেই কিন্তু বিমানের আসন ফাঁকা’ সমস্যা সমাধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নির্বাহী কর্মকর্তারা অনেকবার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এর সঙ্গে বিমানের ‘ভেতরের ও বাইরের যে চক্র’ জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম, উড়োজাহাজ ভাড়ায় দুর্নীতি, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, নারীকর্মীদের যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সময় নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। তদন্তে অনিয়ম-অপরাধ প্রমাণিতও হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না।
হাসিনা সরকারের আমলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছিল দুর্নীতির আখড়া। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজ, যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে সব রকম ক্রয়েই ছিল অনিয়ম। শুধু তাই না, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফ্লাইটে খাবার সরবরাহে অপকর্ম, নতুন সফটওয়্যার ক্রয়ে অনিয়মের পাশাপাশি বিভিন্ন কাণ্ডে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি না করে বরং দায়মুক্তির নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বিমানের খরচে বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে অসংখ্যবার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। প্রথম দিনের মতবিনিময় সভায় মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, বিমান পরিচালনা পর্ষদকে সংস্কার করে পুনর্গঠন করা হবে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি, মতিঝিল ও ফার্মগেটে হাইরাইজ ভবন নির্মাণ, দক্ষ জনবল বৃদ্ধি, বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানো, এয়ারপোর্টে যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধি এবং বিমানের টিকিট যেন সর্বসাধারণের কাছে সহজলভ্য হয়, সেসবের জন্য কাজ করতে চান তিনি। কিন্তু কোনোটিই কাক্সিক্ষত মানে নিতে পারেননি এই ‘কিংবদন্তি’। তাহলে তিনি কোন কর্মের জন্য এই খেতাবে ভূষিত হলেন? সত্যিকার অর্থে কিছু করতে চাইলে, বিমানের প্রকৃত সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে। না হলে সমস্যা থাকবেই। শুধু শুধু খেতাবের ভার বহন করে, যারা দুর্নীতির প্রকৃত প্রসাদ ভক্ষণ করেন, তাদের দ্বারা বিমানের প্রকৃত সমস্যার সমাধান দূর কল্পনার বিষয়।