কক্সবাজার দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে করিডর দেওয়ার অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘ। অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর রাজনৈতিক দলগুলো। প্রায় সব দলই মনে করছে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক আলোচনা ও ঐক্যমতের প্রয়োজনীয়তা ছিল। এমন সিদ্ধান্ত দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তার জন্য হুমকিও। অন্তর্বর্তী সরকারের এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
এ তথাকথিত ‘মানবিক করিডরের’ মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত জড়িয়ে গেল। ভূরাজনীতিতে এ তিনটি দেশের স্বার্থ আছে বলেও মনে করছে তারা।
করিডর ইস্যুতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বিষয়টি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব ফেলতে পারে।
এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী, সিপিবিসহ বিভিন্ন দল বলছে, ‘মানবিক করিডর’ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা বা ঐকমত্য ছাড়া সরকারের একক সিদ্ধান্ত ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চেয়েছে বিএনপি। আর জামায়াতে ইসলামী বলছে, বিষয়টি জনগণের সামনে স্পষ্ট হওয়া দরকার। সিপিবি মনে করছে, বাংলাদেশের জন্য করিডর বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
এ ছাড়া জাতিসংঘের অনুরোধের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘করিডর দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ যে অনুরোধ করেছে, তা নিয়ে কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে? কোনো রেজল্যুশন রয়েছে?
গত রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “চলতি বছর প্রথমার্ধে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এমন পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ ‘করিডর’ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।”
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, করিডর দেওয়ার চালু নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে ভিন্নমত আছে। তবে জাতিসংঘের অব্যাহত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এটি দিতে রাজি হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর দেওয়া নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ করিডর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা; অস্ত্র নেওয়া হচ্ছে না।’
জাতিসংঘ জানায়, রাখাইনের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা না গেলে এবার শুধু রোহিঙ্গা নয়, সেখানে বসবাসরত বাকি জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। তাই সেখানকার দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় করিডর দিয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা চাইছে জাতিসংঘ।
গত বছর অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। রাখাইনে পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের আয়ের কোনো উৎস নেই, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস নেমেছে, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ অথবা এপ্রিল মাসের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বের খুব কম মানবিক করিডরই নিরাপত্তাঝুঁকির বাইরে থেকেছে। যদিও মানবিক করিডর দেওয়া হয় সাধারণ নাগরিকদের সহায়তার জন্য। তবে এ ধরনের করিডর চালু হলে সেই অঞ্চলে থাকা বিদ্রোহী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ অপরাধীরা সেটাকে নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশ হয়ে যে ত্রাণ যাবে, তা রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাবে, নাকি আরাকান আর্মি সেগুলোকে দখলে নেবে, তার নিশ্চয়তা ঢাকার কাছে নেই। এর বাইরে এ অঞ্চল বিশ্বে মাদক, অবৈধ অস্ত্র পাচারসহ নানা আন্তঃসীমান্ত অপরাধের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত। করিডর দিলে মাদক বা অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা থাকবে।
জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের প্যানেল অব এক্সপার্টস রোস্টার এবং ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্সের মেডিয়েশন সাপোর্ট ইউনিটে মেডিয়েশন রোস্টারের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের অনুরোধ সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের কোনো রেজল্যুশন আছে? এ ছাড়া এতে আমাদের কী লাভ হবে?
এর বিনিময়ে কি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারবে? পাশাপাশি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী কি এর দায়দায়িত্ব নিতে আগ্রহী কি না? কিংবা তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না? সর্বশেষ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না?
করিডর প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘করিডরের সুফল-কুফল এখনো বলা যাবে না। কারণ আমরা জানি না এটা কীভাবে হচ্ছে। এ করিডর সম্পর্কে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। আমরা জানি, একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে, মিয়ানমারের যে যুদ্ধাবস্থা চলছে সেখানে রোহিঙ্গা আছে, তাদের সাহায্য পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ নীতিগতভাবে করিডরে সায় দিয়েছে। এটুকুই আমরা শুনেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে এটার ব্যবস্থাপনা হবে সে সম্পর্কে আমাদের কাছে পুরো তথ্য নেই। তবে সেখানে যুদ্ধাবস্থা চলছে ফলে রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচানো যাবে এটা ইতিবাচক দিক। নেতিবাচক দিক হলো এটা শুধু মানবিক সাহায্যের প্রয়োজনেই থাকবে না ভিন্ন কিছুও এখানে ঢোকার আশঙ্কা থাকবে, সেটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু করিডর নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু জানানো হয়নি। আপাতত এর বেশি কিছু বলার মতো দেখছি না।’
‘মানবিক করিডর’ ইস্যুতে আলোচনা চায় বিএনপি: ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চেয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে আলোচনা ও ঐকমত্য ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দলটি। বিএনপি মনে করছে, এমন সিদ্ধান্ত দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এমন একটি বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই বলেও দলটির পক্ষ থেকে মত এসেছে।
গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ ইস্যুতে বিস্তর আলোচনা হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বলেন, রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধাবস্থা, আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মধ্যে সংঘাত এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় সত্ত্বেও করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্তে সরকার রাজনৈতিক পরামর্শ ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করছে।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার ব্যাপারে যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বৈঠকে সে ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, মিয়ানমারে যেখানে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে। আরাকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে জান্তা সরকার সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাখাইনে বাংলাদেশের ‘মানবিক করিডর’ দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে এবং দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিষয়টি হুমকি হবে কি হবে না, সেটি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বৈঠকে নেতারা জানান, জাতিসংঘ রাখাইনে যে মানবিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষের কথা বলছে, সেটি নিয়ে বিএনপিও উদ্বিগ্ন। কিন্তু করিডর দেওয়ার আগে রাখাইন রাজ্য নিয়ে প্রতিবেশী আরও দুটি শক্তিশালী দেশ চীন ও ভারতের অবস্থান কী, সেটা নিয়েও আমাদের ভাবার যথেষ্ট প্রয়োজন, অবকাশ রয়েছে।
বৈঠকে বিএনপি সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিএনপি এ ইস্যুতে তাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। একই সঙ্গে রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি এবং এটা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কী করছে, সেগুলো নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে এর যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে জাতির সামনে পুরো বিষয়টি তুলে ধরবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা এখনো বিষয়টা (রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়া) পুরোপুরি জানি না। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, সরকার একতরফাভাবেই দেশের জনগণ তথা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এটাও শুনেছি, মানবিক কারণে তারা এ করিডর দেবে। কিন্তু সেটা কীভাবে দেবে, তা জানি না। আমরা এটাও শুনেছি, কিছু শর্ত আছে কিন্তু সে শর্তগুলো কী, এগুলো আমরা জানি না। তাই আমরা মনে করি, সরকারের এ বিষয়গুলো জাতিকে সুস্পষ্টভাবে জানানো উচিত এবং কী কী শর্ত, সেগুলোও পরিষ্কারভাবে জানানো দরকার। আমরাও এ বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জানার চেষ্টা করছি এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার পর আমরা আমাদের দলের তরফ থেকে এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান ব্যক্ত করব।’
গত সোমবার ঠাকুরগাঁওয়ে এক গণসংযোগ অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল। এটা কথা না বলে তারা (সরকার) এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে হিউম্যানিটরিয়াল প্যাসেজ দেওয়ার জায়গা দিচ্ছে। মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে, জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এটা হতে হবে সব মানুষের সমর্থনে। আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না।
বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করার দাবি জামায়াতের : জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়।’ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে করিডর ইস্যুতে একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তা বিষয় জড়িত থাকতে পারে।’ রোহিঙ্গা সমস্যা, মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি ও মানবিক সহায়তা করিডর বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
সিপিবি মনে করছে সার্বভৌমত্ব সংকটে ফেলবে : তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার খবরে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অন্তর্র্বর্তী সরকারের নেই। সরকার দেশের বিদ্যমান সংবিধান লঙ্ঘন করে এ ভয়ংকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংকটে ফেলবে।’ গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এমন মন্তব্য করেন।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, এই করিডর দেওয়া হলে বাংলাদেশের সীমান্ত অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এমনিতেই মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের বিজিবির নিয়মিত সংঘর্ষ চলছে। এ করিডর দেওয়া হলে মিয়ানমার জান্তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকেও নানা অজুহাতে বিপন্ন করে তুলবে।
সিপিবি নেতারা বলেন, হঠাৎ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর এ উৎসাহ সন্দেহজনক। এটি সাম্রাজ্যবাদের ভূরাজনৈতিক চক্রান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কারণ, জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো মানবিক করিডরের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলের অনেক জায়গায় ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কথা বিবেচনায় না রেখে বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার যদি এ ধরনের দেশবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নেয়, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনতা তাকে প্রতিহত করবে।
বিবৃতিতে নেতারা দেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এবং ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তিকে যেকোনো সুবিধা দেওয়ার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ সচেতনভাবে রুখে দাঁড়াতে গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল সংগঠন ও ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সিপিবির সভাপতি মুহাম্মদ শাহ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্তর্র্বর্তী সরকার বড় বড় কাজ করছে। তবে এ সরকার দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কতটুকু উপকার করবে জানি না। তবে এ করিডর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। এ করিডরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত জড়িয়ে গেল। ভূরাজনীতিতে এ তিনটি দেশের স্বার্থ আছে। আমেরিকার স্বার্থ হলো ভূরাজনীতিতে চীনকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এ রাজনীতিতে আমরা পড়ে গেলে আমাদের দেশের জন্য জাতির জন্য একটা বিপর্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
সিপিবির সভাপতি বলেন, ‘করিডর ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচন ভু-ল হয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা মূলত গ্লোবাল ক্যাপিটালের দূতিয়ালিতে ব্যস্ত। নির্বাচন নিয়ে উনি ভাবছেনই না।’
গণসংহতি আন্দোলনের বিবৃতিতে উদ্বেগ : ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে গণসংহতি আন্দোলন। গতকাল গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সংকটের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ বিষয়ে বিশদ আলাপ-আলোচনা ও ঐকমত্য প্রযোজন। কারণ এর সঙ্গে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার গুরুতর বিষয় জড়িত। এরকম জাতীয় বিষয় জাতীয় ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। আমরা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত পরিস্থিতি ও মানবিক করিডর বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানাই।
জাতিসংঘ বা কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি: এদিকে ‘মানবিক করিডর’ স্থাপন নিয়ে চলমান আলোচনার মধ্যে প্রধান উপেদষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে, সরকার তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।’ গতকাল এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপেদষ্টার প্রেস সচিব এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার মনে করে, যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।’
শফিকুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ সংকটকালে অন্যান্য দেশকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে বরাবরই উদাহরণযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মিয়ানমারে ভূমিকম্পের পর আমাদের সহায়তা।’
প্রেস সচিব জানান, তারা আশঙ্কা করছেন যে, এই ভোগান্তি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে আরও মানুষের বাংলাদেশে আসার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ অবস্থা বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে না।
শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘ-সমর্থিত মানবিক সহায়তা রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে এবং শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে সহায়ক হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে সাহায্য পাঠানোর একমাত্র কার্যকর পথ হলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এই পথ ব্যবহার করে সাহায্য পরিবহনে লজিস্টিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত। রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’