মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তার জ্ঞান কিংবা বাহ্যিক উন্নতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। বরং তা নির্ধারিত হয় তার চরিত্র ও আচরণগত সৌন্দর্যের মাধ্যমে। ইতিহাস সাক্ষী, সভ্যতা গড়ে উঠেছে তখনই, যখন মানুষ তার চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়েছে এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীলতা অনুভব করেছে। একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার বা একটি সমাজ তখনই বিকশিত হয়, যখন সেখানকার মানুষগুলো মানবিক গুণাবলি চর্চা করেন। এই গুণাবলির মধ্যে বিশেষভাবে চারটি গুণ মানুষের জীবন ও সমাজকে আলোকিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা হলো কোমলতা, নমনীয়তা, ঝগড়া পরিহার এবং সুন্দর ব্যবহার।
আজকের ব্যস্ত, প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও আত্মকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় এই গুণগুলো ক্রমেই বিলুপ্তপ্রায়। মানুষ দ্রুত রেগে যায়, তর্কে লিপ্ত হয়, পরস্পরকে সহ্য করতে চায় না। মতের অমিলকে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হিসেবে না দেখে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে জন্ম নেয় বিভাজন, বিদ্বেষ ও সহিংসতা। অথচ ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, যেসব মনীষী সমাজকে বদলে দিয়েছেন, তারা সব সময় মানুষের সঙ্গে কোমল ভাষায় কথা বলেছেন, নমনীয় আচরণ করেছেন, অপ্রয়োজনীয় ঝগড়া এড়িয়ে চলেছেন এবং সর্বোচ্চ সুন্দর ব্যবহার প্রদর্শন করেছেন।
কোমলতা এমন এক মানবিক গুণ, যা অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত হয়। এটি দৃশ্যমান নয়, কিন্তু এর প্রভাব স্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী। কোমলতার বিপরীতে আছে কঠোরতা, যা সম্পর্ককে জীর্ণ করে তোলে, মনকে আড়ষ্ট করে দেয়। অপরদিকে কোমলতা একটি কোমল হাতের স্পর্শের মতো, যা ব্যথিত হৃদয়ে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দেয়। নবী করিম (সা.)-এর জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখি, তিনি অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির ছিলেন। কখনো তিনি কারও সঙ্গে কঠোর বা রূঢ় আচরণ করেননি, এমনকি শত্রুকেও অমায়িক ভাষায় উত্তর দিয়েছেন। কোমলতা মানে দুর্বলতা নয়। বরং এটি এমন এক দৃঢ়তা, যা ক্রোধকে সংবরণ করতে জানে, প্রতিশোধের আকাক্সক্ষাকে জয় করতে পারে এবং শান্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। শিশুদের প্রতি, দুর্বলদের প্রতি, এমনকি সমাজের ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতিও কোমলতা প্রদর্শন একজন মানুষের অন্তরের মহত্ত্বকে প্রকাশ করে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি যদি কঠোর হতেন, কঠিন হৃদয়ের হতেন, তবে তারা আপনার চারপাশ থেকে সরে যেত।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৫৯)
জীবন সর্বদা সহজভাবে চলে না। জীবনে ওঠানামা আছে, দ্বিধা আছে, মতানৈক্যও আছে। এসব মোকাবিলায় নমনীয়তা অবলম্বন প্রয়োজন। একটি অনমনীয় মন বা আচরণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। নমনীয়তা মানুষকে সহজ করে তোলে, তাকে বাস্তবতা গ্রহণে প্রস্তুত করে। এটি আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে অপরের অবস্থানকে বুঝতে শেখায়। একজন নমনীয় ব্যক্তি শুধু নিজেকে নয়, সমাজকেও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। নমনীয়তার অভাব থেকেই জন্ম নেয় গোঁড়ামি, একপেশে চিন্তা ও অহঙ্কার। পক্ষান্তরে নমনীয়তা হলো বিনয়ী হৃদয়ের প্রকাশ, যা মানুষকে ভুল স্বীকার করতে শেখায়, শোধরানোর পথ খুলে দেয় এবং সম্পর্কের সেতুবন্ধন শক্ত করে। ইসলামে নমনীয়তাকে মহৎ গুণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। নবী করিম (সা.) বহুবার নিজের সিদ্ধান্তে সাহাবিদের পরামর্শ যুক্ত করে নমনীয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ঝগড়া মানুষের অন্তরের অস্থিরতা এবং অসহিষ্ণু মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এটি সম্পর্কের ফাটলকে গভীর করে, সমাজকে বিভক্ত করে এবং আত্মাকে বিষিয়ে তোলে। ঝগড়া কখনো কোনো সমাধান দেয় না, বরং তা নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দেয়। ঝগড়া যদি হয় মতভেদ থেকে, তবে নমনীয়তা তা প্রশমিত করতে পারে। যদি হয় অহঙ্কার থেকে, তবে বিনয় তা দমন করতে পারে। ইসলাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি জান্নাতের একটি ঘরের জামিন, সে ব্যক্তির জন্য, যে তর্কে জয়ী হওয়ার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তর্ক পরিহার করে।’ (আবু দাউদ) এই হাদিস আমাদের বুঝিয়ে দেয়, ঝগড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখার মাঝে এক ধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি নিহিত রয়েছে। ঝগড়ায় জেতা মানে সম্পর্ক হারানো আর ঝগড়া থেকে সরে আসা মানে সম্পর্ক রক্ষা করা। কণ্ঠের উচ্চতা নয়, বরং হৃদয়ের প্রশান্তিই প্রকৃত বিজয়।
সুন্দর ব্যবহার একজন মানুষের সর্বোত্তম গুণাবলির অন্যতম। কথায় আছে, ‘ভদ্রতা বিনিময়যোগ্য’, আপনি যেমন ব্যবহার করবেন, অন্যরাও তেমনই ব্যবহার করবে। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে চরিত্রবান, তারা প্রতিক্রিয়াশীল আচরণে বিশ্বাসী নয়, তারা নিজের আচরণকে নিজেদের মানদণ্ডে পরিচালিত করেন। সুন্দর ব্যবহার মানুষকে সম্মানিত করে, সমাজে গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়, এমনকি শত্রুকেও বন্ধুত্বে পরিণত করে দেয়। একজন মানুষ অন্যকে কেমন ভাষায় কথা বলছে, কতটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে, বিপদে এগিয়ে আসছে কি না, এসবই তার চরিত্রের অংশ। নবী করিম (সা.)-এর জীবনে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রতিটি মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। এমনকি এক বুড়ি, যিনি তাকে গালমন্দ করতেন, তার অসুস্থতায় তিনি নিজে খোঁজখবর নিতে গেছেন। এই ঘটনাগুলো শুধু ইতিহাস নয়, এগুলো জীবনের পাঠ।
চারটি গুণ কোমলতা, নমনীয়তা, ঝগড়া পরিহার ও সুন্দর ব্যবহার, এগুলো ব্যক্তির ভিতকে যেমন গড়ে তোলে, তেমনি গোটা সমাজে এক নীরব বিপ্লব ঘটায়। আজকের দিনে যখন মতের অমিলকে শত্রুতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ভিন্নমতকে দমন করা হয় এবং বিতর্ককে বিকল্প চিন্তার সুযোগ না দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করা হয়, তখন এই চারটি গুণের প্রয়োজনীয়তা আরও গভীরভাবে অনুভূত হয়। এগুলো অর্জন করা সহজ নয়, তবে চর্চার মাধ্যমে সম্ভব। যে সমাজে এই গুণগুলোকে মূল্য দেওয়া হয়, সেখানে সহনশীলতা বাড়ে, দ্বন্দ্ব কমে এবং মানুষ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। আত্মশুদ্ধির পথেও এগিয়ে যায় মানুষ, কারণ এই চারটি গুণ আত্মাকে প্রশান্ত করে, বিবেককে জাগ্রত করে।
আমাদের সবার জীবনে যেন এই চারটি গুণের প্রতিফলন ঘটে, সেটাই হোক কাম্য। কোমল হই, নমনীয় হই, ঝগড়া এড়িয়ে চলি এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে আপন করে নিই। তাহলেই গড়ে উঠবে এক মানবিক সমাজ, যেখানে সৌন্দর্য থাকবে ভাষায়, আচরণে ও কার্যকলাপে।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক