রপ্তানি বাজারের বড় প্রতিযোগী পাকিস্তান কম রপ্তানি করায় চাহিদা বেড়েছে বাংলাদেশি আলুর। এতে করে মালয়েশিয়া নেপাল শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর বাজারের যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে তা পূরণে বাংলাদেশ থেকে এ বছর বাড়তি আলু রপ্তানি হচ্ছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও রপ্তানিকারকদের দেওয়া তথ্য থেকে।
কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ গত ২৬ বছর ধরে আলু রপ্তানি করলেও প্রায় এক যুগ আগে পরিমাণ ১ লাখ মে.টন ছাড়িয়েছিল একবারই। ২০১৩ সালের পর থেকে নানা কারণেই কমেছে আলুর রপ্তানি, যা গত অর্থবছরে নামে মাত্র ১২ হাজার টনে। এই অর্থবছরের ৬ মে পর্যন্ত রপ্তানির তথ্য থেকে জানা গেছে, ৪৮ হাজার ১৭৭ মে. টন ছাড়িয়েছে আলুর রপ্তানি। এখন পর্যন্ত যেটুকু রপ্তানি হয়েছে তা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪ গুণ বেশি। এই রপ্তানি ৬০ হাজার মে. টন ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২ হাজার ৩৯২ মে.টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬২ হাজার ৭২৬ মে.টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫১ হাজার ৭৬৩ মে.টন রপ্তানি হয়েছিল।
জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশ থেকে আলু রপ্তানির আয় ছিল সর্বোচ্চ ৩৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি। যা গত কয়েক বছর ১০ মিলিয়ন ডলারের আশপাশে নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাকিস্তান এবারে সেভাবে আলু রপ্তানি করছে না, যদিও দেশটি মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যে আলু রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী। সাম্প্রতিক সময়ের ভারত-পাকিস্তান সংকটের মধ্যে দেশটির রপ্তানি আরও কমে গেছে। প্রতিযোগী দেশটির রপ্তানি কম হওয়ার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে বাংলাদেশ। কাছাকাছি মানের আলু হওয়ায় বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের আলুর চাহিদা বেড়েছে, ফলে রপ্তানিও বাড়ছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশে এবারে শুধু আলুর সামগ্রিক উৎপাদন ভালো হয়েছে তান্ডই নয়, ভালো জাতের আলুর উৎপাদনও বেড়েছে। এর উৎপাদন খরচের তুলনায় স্থানীয় বাজারে আলুর দাম কম থাকায় রপ্তানি বাজার ধরার ক্ষেত্রে আরও সুবিধা পাচ্ছেন দেশের রপ্তানিকারকরা। এছাড়া বাড়তি চাহিদা, কম কার্গো ভাড়াসহ সরকারি কিছু সুবিধার কারণে রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
আলু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জিল ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হায়দার বলেন, প্রথমত আমরা আলুর দামের কারণে রপ্তানি বাজারে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছি। অন্যদিকে প্রতিযোগী দেশের রপ্তানি কম এবং আমদানিকারক দেশের চাহিদা বেশি থাকার সুযোগটা আমরা কাজে লাগাচ্ছি। এর সঙ্গে কম জাহাজ ভাড়ার কারণে আমরা টনপ্রতি ২৬০-২৮০ ডলারে রপ্তানি করতে পারছি।
রপ্তানিকারক ও ইপিবি-র তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে বেশি আলু রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়াতে। আগেও অবশ্য রপ্তানির আশি ভাগই যেত মালয়েশিয়াতে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আলু রপ্তানি হচ্ছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত বছর রাশিয়া বাংলাদেশের আলু নেওয়ার কথা থাকলেও এখনো দেশটিতে রপ্তানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আলুর উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে। যেখানে দেশে খাওয়ার আলুর চাহিদা রয়েছে ৮৫-৯০ লাখ টন। এর আগে গত দুই বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং কৃষক আলুর উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমে যায়। দামও ৮০ টাকা ছড়িয়ে যায়। যে কারণে রপ্তানিকারক দেশ হয়েও গত বছর আলু আমদানি করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।
এই পরিস্থিতিতে এ বছর আবার আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ার পর থেকেই কৃষকরা লোকসানে পড়ছেন। দাম না পেয়ে অনেক কৃষককে উৎপাদিত আলু রাস্তায় ফেলে দিতেও দেখা গেছে। বাজারেও এবার ভোক্তারা কম দামে আলু কিনতে পারছেন, যেখানে প্রতিকেজি আলু মান ও বাজারভেদে ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে এখন বেশ কিছু ভালো জাতের আলুর চাষ হচ্ছে, যেগুলো রপ্তানি বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। এর মধ্যে সানসাইন, গ্র্যানোলা, ডায়মন্ড, ম্যাজেস্টিক, প্রাডা, সান্তানা, কুইন এ্যানি, কুম্বিকা, ডোনেটা ও বারি আলু-৬২ মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন আলু রয়েছে এই তালিকায় যেগুলো নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে।
যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি উপযোগী জাতের আলুর চাষ এখনো সীমাবদ্ধ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, শিল্পে ব্যবহারযোগ্য আলুর জাত সম্প্রসারণে নিয়মিত কাজ চলছে, যেগুলো রপ্তানি বাজারের জন্য উপযোগী। আবার নতুন কিছু জাত এসেছে যা একই পরিমাণ জমিতে দ্বিগুণেরও বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব। আমরা এগুলো দ্রুত বিস্তারে কাজ করছি।
বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ফেরদৌসী বেগম বলেন, ভালো মানের আলুর ঘাটতির মধ্যেও বিএডিসি-র সানসাইন নামের নতুন একটি জাতের চাষ হয়েছে। যা রপ্তানি বাজারে ভালো করছে। তিনি জানান, এ বছর আলুর প্রচুর চাহিদা রয়েছে, যা পূরণে রপ্তানিকারকরা প্রচুর কাজ করছেন। কিছু সুবিধা সরকারের দিক থেকেও পাচ্ছি। বিআরটিসির যে ট্রাকগুলো বন্দরে যাচ্ছে তারা আমাদের রপ্তানির আলুগুলো পরিবহন করছে, এতে করে এই পরিবহন খরচটা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।