একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর বা সীমান্ত থেকে উচ্চ শুল্ক এবং জটিল শুল্ক বিধিমালার কারণে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো তৈরি হয়, তা দূর করা। বৈশি^ক বাণিজ্যের মাধ্যমে ধনী দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শ্রম, প্রযুক্তি, মূলধনসহ অন্যান্য সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। এজন্য সঠিক বিনিয়োগ পরিবেশ প্রয়োজন। দেশের আমদানি ও রপ্তানির প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। এ সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন শিল্প ও কারখানা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত সুবিধা তো রয়েছেই। পাশাপাশি বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ, সস্তা শ্রমসহ বহুমাত্রিক সুবিধাও আছে। দেশে বৈশ্বিক বিনিয়োগের দুয়ার খুলতে গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’ হয়েছে। এরপর চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) ও মিরসরাই শিল্পনগর পরিদর্শন করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ৫৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় ৪০০ একর জমির ওপর একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল (এফটিজেড) গড়ে তোলা হবে। বিষয়টিকে তিনি দেশের অর্থনীতির জন্য ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিডা চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ‘মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল অনেকটা বিদেশি ভূখণ্ডের মতো। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে কারখানা স্থাপন করে পণ্য বিদেশে পাঠাতে পারবে। তারা দেশের দপ্তরগুলোর ঝামেলা ছাড়াই কাজ করতে পারবে। এতে দেশের বিশাল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উভয় পক্ষই লাভবান হবে।’ এ বিষয়ে শুক্রবার দেশ রূপান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক রাজধানী হতে পারে, কিন্তু চট্টগ্রাম আমাদের বিজনেস হাব। বাংলাদেশকে আগামীর ম্যানুফ্যাকচারিং হাব করার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমরা এগোচ্ছি এতে চট্টগ্রামই হবে মধ্যমণি। আর তা বাস্তবায়ন হবে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে তিন বিলিয়ন ডলারের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্র্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান এমন মন্তব্য করেছেন।
বে টার্মিনাল বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে পিএসএ সিঙ্গাপুর এবং দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি এক বিলিয়ন করে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার এখানে বিনিয়োগ করবে। এ ছাড়া ব্রেক ওয়াটার ও রেললাইন এবং বিভিন্ন কানেকটিভিটির জন্য অর্থায়ন করছে বিশ^ব্যাংক। অপরদিকে লালদিয়ার চরে নেদারল্যান্ডসের মায়ারসক এপি মুলার টার্মিনাল নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। এখানে ৮০০ মিলিয়ন ডলার এবং এনসিটি কনটেইনার টার্মিনালে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। আশিক চৌধুরী বলছেন, ‘বে টার্মিনাল, লালদিয়া ও এনসিটিতে তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসছে। শুধু বে টার্মিনাল ইস্যুতে প্রায় ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এই ২৫ হাজারের সঙ্গে নির্ভরশীল সদস্যসহ প্রায় এক লাখ বাড়তি মানুষের আবাস হবে এই নগরে। তাই বাড়তি জনসংখ্যার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসন নিয়ে এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’
‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’ শীর্ষক বিনিয়োগ সম্মেলনের অনানুষ্ঠানিক যাত্রার প্রথম দিন দেশি-বিদেশি আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের চট্টগ্রামের দুটি বিশেষ শিল্প এলাকা পরিদর্শন করানো হয়েছিল। তারা কেইপিজেডে অবস্থিত ইয়াংওয়ান করপোরেশনের বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখেন এবং বিকেলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও শিল্প কারখানায় সংঘাতের পর বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল উদ্বেগ। সেই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। এই মুহূর্তে যা জরুরি তা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগে বিদেশিদের উৎসাহিত করা। এজন্য যা দরকার, তা যেন করা হয়। কাজটা শুধু সরকারের নয়। মনে রাখতে হবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতাই বাংলাদেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে।