বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

নার্স ঘাটতি ৭৪ শতাংশ

আপডেট : ১২ মে ২০২৫, ০৭:১৬ এএম

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স প্রয়োজন। বাংলাদেশে তা উল্টো। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার। সে হিসেবে নার্স প্রয়োজন ৪ লাখ ২ হাজার। কিন্তু বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফার কাউন্সিল নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ চিকিৎসক অনুপাতে নার্স সংকট ২ লাখ ৯২ হাজার। সে হিসেবে ৭৪ শতাংশ নার্সের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের স্বাস্থ্য খাত।

শুধু নার্স সংকটই নয়, নার্সিং পেশা ও নার্সিং শিক্ষারও দুরবস্থার কথা বলেছেন নার্সরা। তাদের তথ্যমতে, এখনো দেশে নার্সিং শিক্ষায় কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নার্সিং কলেজগুলোয় শিক্ষকদের জন্য পদ সৃজন করলেও গত পাঁচ বছরেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কলেজগুলো চলছে ২০০৮ সালের আগের ডিপ্লোমা নার্স দিয়ে। অর্থাৎ এসএসসি পাস ডিপ্লোমা নার্স এখন পড়াচ্ছেন বিএসসি ইন নার্সিং ব্যাচেলর গ্রাজুয়েট কোর্সের শিক্ষার্থীদের। ফলে নার্সিং শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এমনকি উন্নত বিশ্বের তুলনায় এদেশের নার্সদের বেতন প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ কম। ৯০ শতাংশ নার্সের আবাসন ব্যবস্থা নেই। এখনো চালু হয়নি ঝুঁকি ভাতা। ২৫ বছর আগের ইউনিফর্ম ভাতা এখনো রয়ে গেছে। ধোলাই ভাতা হিসেবে মাসে পাচ্ছেন মাত্র ২১৯ টাকা। সরকারি নার্সদের ৯০ শতাংশেরই পদোন্নতি হচ্ছে না। সরকারের ঘোষণার পরও পদবিন্যাস হয়নি, যা খুবই দুঃখজনক। একজন নার্স দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যদায় দশম গ্রেডে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে সরকারি চাকরিতে ঢুকছেন। অবসরও নিচ্ছেন সেই একই গ্রেড ও পদে। পদোন্নতি না হওয়ায় তাদের বেতনও বাড়ছে না।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) সভাপতি খাঁন মো. গোলাম মোরশেদ নার্সিং খাতে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে নার্সদের বেতন কাঠামো ও ঝুঁকি ভাতা অপ্রতুল। নার্সদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশাসনিক ও ক্যারিয়ার অগ্রগতির সুযোগ নেই। নার্সিং শিক্ষার মান ও তদারকি দুর্বল। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নার্সদের চাকরি পরিস্থিতির মধ্যে বৈষম্য বিদ্যমান। বিদেশে নার্সদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিদ্যমান নিয়োগ, অর্গানোগ্রাম ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়। নার্সিং খাতের কাঠামোগত উন্নয়ন ও নার্সদের কর্মপরিবেশের মানোন্নয়ন না ঘটালে স্বাস্থ্যসেবায় কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ন্যাব) এর যুগ্ম মহাসচিব ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস (এসএনএসআর)-এর মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ তিহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে দেশে প্রয়োজনীয় নার্স নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ও উন্নত বেতন কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে নার্সিং পেশা হুমকির মুখে রয়েছে। নানাবিধ সংকট ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এই পেশা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। দেশের নার্সরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। গত ১৫ বছরে নার্স নিয়োগ হলেও নার্সিং পেশার কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পদে প্রশাসনের লোক, নেই পদোন্নতি : সরকারি পর্যায়ের নার্সরা মোটা দাগে বেশ কিছু সংকটের কথা বলেছেন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, নার্সদের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে মহাপরিচালক ও পরিচালকসহ ৯১ শতাংশ পদেই নিয়োগ পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে যেভাবে পারছে এই পেশায় প্রভাব বিস্তার করে নিজের সুবিধাটুকু আদায় করে নিচ্ছে। বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই পেশাকে নষ্ট করে দিয়েছেন। তারা অল্প সময়ের জন্য অধিদপ্তরে আসেন ও সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চলে যান। এই পেশা বুঝে ওঠার আগেই তাদের বদলি হয়ে যায় ও তারা চলে যান। আবার যিনি এই পেশাটা ভালো বোঝেন তিনি এ পেশায় থাকতে পারেন না। এই ভুতুড়ে ব্যবস্থার ওপর নার্সিং শিক্ষাব্যবস্থা, নার্সিং পেশা ও নার্সিং প্রশাসন দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে এই পেশার সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই।

নার্সরা জানিয়েছেন,  হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নার্সদের সাত ধরনের পদ আছে। কিন্তু পদোন্নতি পাচ্ছেন চার পদের নার্সরা। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ নার্সেরই কোনো পদোন্নতি নেই। এ জন্য নার্সরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেছেন। তারা জানান, সরকারের ঘোষণার পরও পদবিন্যাস হয়নি। একজন নার্স দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যদায় দশম গ্রেডে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে সরকারি চাকরিতে ঢুকছেন। অবসরও নিচ্ছেন সেই একই গ্রেড ও পদে। পদোন্নতি না হওয়ায় তাদের বেতনও বাড়ছে না।

কলেজ চলছে ইন্সট্রাক্টর দিয়ে : নার্সিং শিক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই বলে জানিয়েছেন নার্সরা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা জানান, ২০০৭ সাল পর্যন্ত এসএসসি পাস করে নার্সিং কলেজে ভর্তি হওয়া যেত। এ ধরনের নার্সদের বলা হয় ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এসএসসি গ্রুপ। এই কোর্স বন্ধ হয়ে যায় ২০০৭ সাল থেকে। এরপর থেকেই নিয়ম হয়েছে এইচএসসি পাস করে নার্সিং কলেজে ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্সে ভর্তির। এটা ৩ বছরের অ্যাকাডেমিক ও ৬ মাসের ইন্টার্নশিপ কোর্স। আরেকটি কোর্স আছে চার বছরের বিএসসি ইন নার্সিং। এখন কলেজগুলোতে শিক্ষকতা করছেন ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এসএসসি গ্রুপ। অর্থাৎ ব্যাচেলার গ্র্যাজুয়েটদের পড়াচ্ছেন ডিপ্লোমা নার্সরা।

নার্সরা জানান, ২০২১ সালেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সরকারি নার্সিং কলেজে শিক্ষক নিয়োগের জন্য পদ তৈরি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এসব কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল কিছুই নেই। ২০০৭ সালের আগে পাস করা এসএসসি ডিপ্লোমা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্সকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সংযুক্তিতে প্রিন্সিপাল ও ইন্সট্রাক্টর বানানো হয়েছে। কোনো কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল। একেকটা কলেজে ৬০-৭০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সকে নার্সিং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যাদের ১-২ বছর সরকারি চাকরি আছে এমন ১৬৩ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সকে ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর প্রভাষক পদে পদোন্নতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সের নার্সরা মামলা করে স্থগিত করে রেখেছেন। এখন তারা বিভিন্ন কলেজে আছেন। তাদের ব্যাচেলর ডিগ্রি লেভেলে পড়ানোর দক্ষতা নেই। কারণ তারা এসএসসি পাস করে নার্সিং পেশায় ঢুকেছেন আজ থেকে ৩০ বছর আগে। এখন ৩০ বছর পরে এসে তারা ইংরেজি মাধ্যমে এইচএসসি পাস সায়েন্স থেকে আসা ভালো ডিগ্রিধারী মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সক্ষমতা তাদের নেই। এখন নার্সিং সিলেবাস ইংরেজি।

ত্রুটিপূর্ণ কারিকুলাম : নার্সিং শিক্ষার কারিকুলাম নিয়েও ক্ষুব্ধ নার্সরা। তারা জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কানাডা ও ফিলিপাইনি নার্স বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিএসসি ইন নার্সিং কারিকুলাম তৈরি করে। সেটি ছিল ৫২শ মার্কসের কারিকুলাম। কিন্তু শিক্ষকতার দায়িত্বে থাকা ডিপ্লোমা নার্সরা (এসএসসি গ্রুপ) তাদের অসুবিধা হওয়ায় ২০১৮ সালে এই কারিকুলাম রিভিউ করেন। তখন এই কারিকুলাম ৩৮শ মার্কসের করা হয়। মার্কস কমানোর কারণে এই কোর্সের নার্সদের বিদেশে চাকরি সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। কারণ এই কারিকুলাম বিদেশের কারিকুলামের সমমানের করতে সেখানে আরও দেড় বছর পড়তে হয়।

এ ব্যাপারে মোরশেদ বলেন, এখন এই দুর্বল কারিকুলাম নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ কঠিন হবে। কারণ তাদের বিদেশে যেতে হলে ওই দেশের শিক্ষার সমমান শিক্ষা হতে হয়। যদি সমমান না হয় তখন বলে এই ডিগ্রি সাব স্ট্যান্ডার্ড আপনাকে এই দেশে আরও পড়াশোনা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে তাদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ কমে যায়। এখন যে কারিকুলাম আছে সেটাকে আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলামে রূপান্তর করতে হবে। এই নার্সদেরই যদি বিদেশে পাঠানো যায় দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসার সুযোগ আছে।

তিন দাবিতে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা : তিনটি দাবিতে বর্তমানে আন্দোলন করছেন নার্সিং শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, বর্তমানে যারা এইচএসসি পাসের পরে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্স করছেন, পাস করার পর তাদের উচ্চমাধ্যমিক সমমানের সনদ দেওয়া হচ্ছে। এতে উচ্চশিক্ষায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি, যেহেতু তারা এইচএসসি পাসের পর নার্সিং কোর্স করছেন, তাই তাদের ডিপ্লোমা ডিগ্রিকে স্নাতক সমমানের করতে হবে।

অন্যদিকে, যারা ব্যাচেলর ডিগ্রি পড়ছেন, তাদের আন্দোলন হলো ১৮ বছর আগে এই কোর্স সরকার শুরু করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনো নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়নি। পাশাপাশি এই কলেজগুলোতে যারা শিক্ষকতা করছেন তারা মূলত হাসপাতালের নার্স, তাদের মূল ডিগ্রি এসএসসির পরে ডিপ্লোমা, এই শিক্ষার ওপর ভর করে তারা ডিপ্লোমা হয়ে গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষাদান করছেন। এখানে প্রকৃত যে শিক্ষা নার্সিং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রয়োজন সেই শিক্ষা তারা পাচ্ছেন না। এর ফলে দেশের নার্সদের গুণগত মান বাড়ছে না ও দেশের বাইরে তাদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে না।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে নার্সিং কলেজগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এই তিন দাবিতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কলেজগুলোতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছেন তারা।

আজ বিশ্ব নার্স দিবস : আধুনিক নার্সিংয়ের জনক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষে এই দিনটি পালন করেন নার্সরা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘আমাদের নার্সরা, আমাদের ভবিষ্যৎ। নার্সদের প্রতি যতœ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে’।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত