প্রত্যাশার মারাত্মক হেরফের পুঁজিবাজারে। খুব অপেক্ষা ছিল পরিস্থিতি দেখা ও আলামত বোঝার। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বাজারকে শক্তিশালী করতে প্রধান উপদেষ্টার রবিবারের নির্দেশনার প্রভাব দৃশ্যমান হয়নি সোমবার। সাম্প্রতিক শেয়ারবাজারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ৯ মাস পর রবিবার শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার হলি-ডেতে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হলো। একেবারে না হওয়ার চেয়ে অন্তত একটি বৈঠক অনেকের মধ্যেই স্বস্তিসহ অপেক্ষা জোগায়। শেয়ারবাজারের উন্নয়ন ও বাজারকে শক্তিশালী করতে বৈঠকটিতে ৫ নির্দেশনা। এগুলো হচ্ছে ১. দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী যেসব বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত বাজারে আনার ব্যবস্থা করা ২. বেসরকারি খাতের ভালো ও বড় বড় কোম্পানিকে প্রণোদনা দিয়ে হলেও বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া ৩. পুঁজিবাজার সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে তিন মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া ৪. অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং ৫. বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংকঋণের বদলে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া। এসব নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। তারপরও আলামত দেখার অপেক্ষা তৈরি হয়।
সোমবার দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়নি। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা থাকলেও দিনের শুরু থেকে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইতে প্রধান সূচকের উল্লম্ফন দেখা যায়নি। ডিএসইতে লেনদেনের প্রথম ১০ মিনিট সূচকের ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেলেও এরপর ব্যাপক ওঠানামা শুরু হয়। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল আতঙ্ক। এরফলে দেশের শেয়ারবাজারে ঢালাও দরপতন দেখা দেয়। নমুনাদৃষ্টে প্রশ্ন উঠেছে, শেয়ার বাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে দেওয়া পাঁচ নির্দেশনার মধ্যে একেবারে নতুন কী আছে? দীর্ঘদিন নয়, বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন আয়োজনে এ ধরনের সুপারিশ শুনে এসেছেন। গত ৮ মাসে শেয়ার বাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি ‘নাই’ হয়ে গেছে বলে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ। বিনিয়োগকারীদের অনেকের বড় ক্ষোভ বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদকে নিয়ে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি অর্থ উপদেষ্টার পরম আত্মীয়। কারও আত্মীয় হওয়া অভিযোগ নয়। কিন্তু, তার ক্ষেত্রে কেন এই অভিযোগ। এ নিয়ে বৈঠকে কোনো কথা বা আলোচনা হয়েছে কি-না, সেই তথ্য নেই। প্রধান উপদেষ্টা নিজের চোখে শেয়ার বাজারকে দেখছেন? না অর্থ উপদেষ্টার আত্মীয়ের চোখ দিয়ে দেখছেন এমন ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্নও উঠেছে। তাই প্রধান উপদেষ্টার শেয়ার বাজার নিয়ে বৈঠকটি বিনিয়োগকারীদের কতটা আস্থা ফেরাতে পারবে, এ নিয়ে ব্যাপক কথা চালাচালি হচ্ছে। শেয়ার বাজার দেশের অর্থনীতির আয়না। পৃথিবীর সব দেশ যে কারণে এমন শেয়ার মার্কেট গঠনে উদ্যোগী হয়। শ্রীলঙ্কা এটা বুঝেছিল। তাই অর্থনীতির চেহারা ফেরাতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। আর এখানে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রায় ৯০ শতাংশ পুঁজিই হাওয়া। ক্রমাগত লোকসানের কারণে গত ৯ মাসে ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে কেনাবেচার বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এই সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক এক হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে। যার কারণে পুঁজিবাজারের যাচ্ছেতাই অবস্থা।
অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো না হলে যত ঝানু ও জ্ঞানী লোক থাকুক না কেন, শেয়ার বাজার চাঙ্গা করা কঠিন। বিশেষত বিদ্যমান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে। বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংকঋণের বদলে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে স্বল্পপুঁজির ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আরও সর্বস্বান্ত করবে কি-না, এ কানাঘুষাও আছে। পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর সক্রিয়, দক্ষ ও আর্থিকভাবে সক্ষম উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। দুঃখজনকভাবে, বিগত সময়ের কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাবে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনার ফলে আইসিবি এখন হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ না ঘটলে বাজারে স্বাভাবিক বিনিয়োগ বা হস্তক্ষেপ করা সম্ভব নয়। আধুনিক বিশ্বে শেয়ারবাজার যে কোনো দেশের অর্থনীতির হৃৎস্পন্দন। এর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদার ও দূরদর্শী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বিগত ৩০ বছর যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের পুঁজি শেষ। নতুন করে সেখানে বিনিয়োগকারী আনতে পারার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ দল এলে নতুন বিনিয়োগকারীর আগমন ঘটবে? দেশে কি পুঁজিবাজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দল নেই? এসব প্রশ্ন নিষ্পত্তিহীন থাকছে। লুকানোর কোনো সুযোগ নেই যে, দেশের শেয়ারবাজার এখন আইসিইউতে। একে উদ্ধার করতে বাইরে থেকে একজন বিশেষজ্ঞকে হায়ার করে আনা হয়েছে। পদ দেওয়া হয়েছে- উপ-উপদেষ্টা যা একজন প্রতিমন্ত্রীর সমান। বিগত দুই যুগে যাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে বসানো হয়েছে, তারা সবাই সরকারের ইচ্ছায়ই বসেছেন। সরকারের উচ্চমহলের ইচ্ছায় কাজ করেছেন। দুর্বল পচা কোম্পানির শেয়ার বুক বিল্ডিং সিস্টেমে উচ্চমূল্যে বাজারে আনার বিষয়ে অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। ওইসবের ৭০ শতাংশ এখন মৃত অবস্থায়। ৫ আগস্টের পর বিএসইসি চেয়ারম্যান এবং অনেক সদস্যকে চলে যেতে হয়। কিন্তু তাদের স্থলে যাদের বসানো হয়েছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারা এই গ্রহেরই। আওয়ামী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আর ব্যাংকে চাকরিতে ছিলেন কেউ কেউ। বিনিয়োগকারীদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগের পথের পথিকই তারা।
২৪-এর ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর পরিবর্তনের আশায় ৬-৭-৮ আগস্ট মানুষ নতুন সরকারের প্রতি আশাবাদী হয়। তলানিতে পড়ে থাকা শেয়ারের মূল্যে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। আর ৮ আগস্ট নতুন সরকার ক্ষমতায় বসতে না বসতেই বাজারে দরপতন শুরু হয়। ৯ মাস ধরে তা চলছেই। করপোরেট কালচারে ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নৈমিত্তিক ঘটনা। ভালো করলে পুরস্কার, ব্যর্থ হলে অপসারণ। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে বড় ব্যত্যয়। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, শাসনব্যবস্থা সবকিছু মিলিয়ে পুঁজিবাজারে জনআস্থা সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের কিছু কারবারির কারসাজিতে যে দুইবারের ধস নামে, সেখান থেকে আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজ করতে পারলেই শেয়ার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে, এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। কিন্তু, আলামত কি তেমন? গত ৮ মাসে বাজারে কারসাজি নিয়ে তেমন কোনো তদন্ত করা হয়নি। বেশিরভাগ তদন্ত জুলাই বিপ্লবের আগেই হয়েছিল। এখন বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনার আড়ালে নতুন কোনো সিন্ডিকেট মোটাতাজা হয় কি না, এ শঙ্কাও ঘুরছে। তারপরও দেরিতে হলেও জরুরি মনে করার কারণেই হয়েছে বৈঠকটি। নির্দেশনাগুলোও প্রাসঙ্গিক। অভিযোগ আছে, এমন কোম্পানি ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত-নির্দেশনাও জরুরি ছিল। এসব সিদ্ধান্তের একটা প্রভাব নিশ্চয়ই এ সপ্তাহেই পড়তে শুরু করবে। ছোট-বড় বিনিয়োগকারীদের কামনা সূচক রথের চাকা ঘুরুক। ডানা মেলে ঊর্ধমুখী উড়ুক। সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধ দামামা কেবল দেশের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রতে নাড়া দেয়নি। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ-উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশীয় পুঁজির নিরাপত্তা, ছোট-বড়-মাঝারি বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের তাগিদও দিয়েছে। সরকারের অভ্যন্তরেও অনুভূতির একটা নাড়া পড়েছে। কারণ, অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক বাজার সম্প্রসারণ করতেই হবে।
দেশি-বিদেশি জাত না খুঁজে বিনিয়োগ বাড়ানো, পুঁজিবাজারের শক্তি বাড়ানো, জনবান্ধব করনীতি সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের ঋণনির্ভরতা কমাতে বিনিয়োগ, উৎপাদন বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎস ও পুঁজিবাজার ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। একটু বিলম্বে হলেও সরকার সেই পথ মাড়াতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান। প্রয়োজনে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ছোট-বড়দের সঙ্গে সরকার দফায় দফায় বসতে পারে। গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা পাওয়া সরকারের জন্য কঠিন নয়। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে বসলে তারা আরও পথ দেখাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ আকাক্সক্ষা ও চাহিদা হচ্ছে তাদের রাজনীতিমুক্ত রাখা। নিশ্চিন্তে ব্যবসায় মনোযোগী থাকতে পারা। সেইসঙ্গে গুরুতর অভিযোগে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত অবশ্যই করতে হবে। তা ব্যবসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা উৎপাদনের চাকা বন্ধ করে নয়। ব্যাপক বিনিয়োগ, গতিময় ব্যবসা, চাঙ্গা পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধিসহ সম্ভাবনার দরজা-জানালা খোলা রাখা সরকারকে বাজেট সহায়তা দিতে পারে। তখন বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে এত ধরনা দিতে হবে না। দেরিতে হলেও পুঁজিবাজারের দিকে সরকারের মনোযোগ ও উচ্চমানের বৈঠকটিকে তাই ইতিবাচক হিসেবে নেওয়া যায়। সেখানে মাত্রা যোগ হতে পারে ছোট-বড় বিবেচনা না করে বিজনেস কমিউনিটির সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো। সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধ ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। বিশেষ করে; দেশের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র, অর্থ, শিল্প, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার তাগিদ নির্দেশ করছে এ যুদ্ধ। আসন্ন পরিবর্তনে আন্তঃশক্তির ব্যাপক উত্থানের সম্ভাবনা স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তাগিদ দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশীয় পুঁজির নিরাপত্তা, ছোট, মাঝারি বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশে মনোযোগী হওয়ার। অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক বাজার সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করারও।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ বাংলাভিশন