বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

জনগণই পারে দল মুছে ফেলতে

আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ০৭:১৩ এএম

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত গণআন্দোলন রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন মোড় নিয়েছে। এই আন্দোলনের পরিণতিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে, ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন করে বা নির্বাহী আদেশে দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ বা মুছে ফেলা যায় না। জনগণই পারে একটি দলকে মুছে ফেলতে। অতীতে অনেক বড় বড় দল হারিয়ে গেছে জনগণ চায়নি বলে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কী প্রতিক্রিয়া আসে, সেটাও দেখতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ সিদ্ধান্তে আনন্দিত হয়েছে বললেও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের মাধ্যমে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের পক্ষে আবারও জোরালো অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনের আগে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে, তা এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দলটির নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের রাজনৈতিক প্রভাব পুরোপুরি নিঃশেষিত হবে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আইনকানুন বা নির্বাহী আদেশ দিয়ে কোনো দলকে মুছে ফেলা যায় না। এটা জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।। জনসমর্থন না থাকলে কোনো দলই রাজনৈতিক মাঠে টিকতে পারেনি, পারবে না। তাই তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। তারাই সবচেয়ে বড় নিয়ামক।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকেও আওয়ামী লীগ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু তাদের মুছে ফেলা যায়নি। আবার মুসলিম লীগ কিন্তু একসময় প্রচ- জনপ্রিয় ছিল। জনসমর্থন না থাকায় তারা কিন্তু আজ দল হিসেবে টিকে থাকলেও রাজনৈতিক মাঠে দাপট নেই বললেই চলে। তাই জনগণকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নিষিদ্ধ হবে কি না বা নির্বাচনে যেতে পারবে কি না, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। এটি পরিষ্কার হতে আরও সময় লাগবে। আন্তর্জাতিক বিশ^ কীভাবে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেয় সেটির জন্যও অপেক্ষা করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নিষিদ্ধ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান (জানিপপ) অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘কার্যকর গণতন্ত্র দেশে কায়েম করতে হলে দেশের সব পর্যায়ের মানুষের মতামত লাগবে। দেশে কার্যকর গণতন্ত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায়। সে হিসেবে দেশের বড় একটা অংশকে বাদ দিয়ে যদি গণতন্ত্র কার্যকর করা হয়, সেটি বহির্বিশ্ব কতটুকু মেনে নেবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন, শেখ হাসিনার রাজত্বের অবসান হয়েছে। হাসিনার প্রস্থান ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দেশান্তর ও শীতনিদ্রার কারণে এমন অবস্থার (সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ) তৈরি হয়েছে। তবে আইনের মাধ্যমে তাদের বিচার করতে এ সরকারকে সময় দিতে হবে।’

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘জনগণ চাইলে যেকোনো জিনিস ফিরে আসতে পারে। তবে স্বৈরাচারের সময়ে গুম খুনসহ সব ধরনের নির্যাতনের বিচার হওয়া উচিত। এর মাধ্যমেই শুধু ন্যায্যতা ফিরে আসতে পারে।’

তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। শিগগিরই এ আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয়। আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক সহিংসতা চালায়, যার ফলে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর প্রায় ১ হাজার ৪০০ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে। আন্দোলনের চরম মুহূর্তে ৫ আগস্ট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। এরপর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, কার্যত দলটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার অপেক্ষা। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার হলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপরও শাস্তির খড়গ নেমে আসতে পারে।

জানা গেছে, ব্যক্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেও ট্রাইব্যুনালকে বিচারের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। ফলে যদি শীর্ষ নেতারা গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত হন, তবে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে। এমন পরিস্থিতির শঙ্কায় দলের ভেতরে অস্থিরতা বাড়ছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। অনেকেই দলীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। নিষিদ্ধ থাকলে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা দলের নেতাদের অংশগ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া বিচারিক প্রক্রিয়া নির্বাচনের আগে গতি পেলে অনেক শীর্ষ নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারাতে পারেন। এতে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগহীন এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

যদিও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিতে শাহবাগের মিছিল-সমাবেশের প্রসঙ্গ টেনে গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম মিলনায়তনে এক স্মরণসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘কোন দাবিতে মিছিল-মিটিং করল? আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে। তো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে না করছে কে? খুব বলা হয়েছিল, বিএনপি নাকি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। বিএনপির কি ঠেকা পড়ে গেছে ভাই? বিএনপির নেতাকর্মীরা ১৭ বছর বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি। আমাদের জীবন থেকে ১৭ বছর কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র নেতারাসহ আমিও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে একাধিকবার স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছি।’

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে দেশের মানুষের সমর্থন ছিল জানিয়ে ডিআরইউ সাগর-রুনি মিলনায়তনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) এক মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের সব অধিকার খর্ব করেছিল। এজন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল। সব দলের সঙ্গে সরকারের কনসালটেশন (পরামর্শ) হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে দেশের মানুষের সমর্থনও ছিল। তাই কোথাও কোনো আন্দোলন হয়নি।’

এ পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের মতামত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও তাদের রাজনৈতিক প্রভাব পুরোপুরি নিঃশেষিত হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত