ইতিহাসের পাতায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক মানেই যেন দ্বন্দ্ব, সংঘাত, যুদ্ধ আর অবিশ্বাসের কাহিনি। ১৯৪৭-এর রক্তাক্ত বিভাজনের পর থেকে শুরু হওয়া এ তিক্ত সম্পর্ক একবিংশ শতাব্দীতেও স্থির হয়নি। সম্প্রতি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র এক সামরিক সংঘাত ঘটে। উভয় দেশই নিজেদের বিজয় দাবি করলেও বাস্তবে এ সংঘাতে কোনো স্পষ্ট বিজয়ী নেই বলে গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
এদিকে যুদ্ধ ঘিরে প্রথমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দেওয়া ভাষণের শুরুতে তিনি পেহেলগামে হামলার ঘটনায় দেশটির সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের অভিযানের প্রশংসা করেছেন। মোদি বলেছেন, একজন নারীর সিঁদুর মুছে ফেলার মূল্য কতটা চড়া হতে পারে, তা সশস্ত্র বাহিনীর পদক্ষেপে নিশ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া কোনো ধরনের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল সহ্য করা হবে না বলেও হুমকি দিয়ছেন তিনি।
মোদি বলেন, আর সন্ত্রাসবাদীদের চোখরাঙানি সহ্য করবে না ভারত। পাকিস্তানকে যদি বাঁচতে হয় ওদের সন্ত্রাসের পরিকাঠামো নির্মূল করতে হবে। ‘টেরর’ ও ‘টক’ (সন্ত্রাস ও আলোচনা) একসঙ্গে চলতে পারে না। পানি ও রক্ত একই সঙ্গে বইতে পারে না। তিনি বলেন, বিশ্বে বড় বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা একই সুতোয় বাঁধা। তাই ভারতের হামলায় সন্ত্রাসবাদের ‘হেড কোয়ার্টার’ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান হতাশ। ওরা নিরাশায়। এ অবস্থায় ওরা আরও একটা ভুল করেছে। ভারতের সঙ্গ দেওয়ার বদলে ভারতের ওপরই হামলা করল! তিন দিনে পাকিস্তানকে যা করা হয়েছে, যা ওরা ভাবতেই পারেনি। এখন তারা বাঁচার রাস্তা খুঁজছে। দেশে দেশে ঘুরছে। খারাপ ভাবে হেরে যাওয়ার পর ১০ মে পাকিস্তানি সেনা আমাদের ডিজিএমওর দ্বারস্থ হয়। তার আগে আমরা পাকিস্তানের মাটিতে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছি।
এদিকে জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক অপারেশনের প্রধান কর্মকর্তাদের (ডিজিএমও) মধ্যে টেলিফোনে আলোচনা হয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধারী দুই প্রতিবেশীর মধ্যে গত সপ্তাহে তীব্র সংঘর্ষের ও শনিবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর এটিই প্রথম সরাসরি যোগাযোগ।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, এ বিষয়ে এখনো কোনো বিস্তারিত বিবৃতি দেয়নি পাকিস্তান। তবে তারা দুপক্ষই শান্তি রক্ষায় আন্তঃসংশ্লিষ্ট যোগাযোগ চালিয়ে যাবে বলে নিশ্চিত করেছে। অবশ্য এর আগে একবার বলা হয়েছিল, ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক প্রধানদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার জন্য নির্ধারিত বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে।
গত শনিবার যুদ্ধবিরতির ঠিক পরপরই নিজেদের জয় দাবি করে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচার শুরু হয় পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে। কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের ওপর ভারতের সামরিক পদক্ষেপ একটি দৃঢ় ও সাহসী বার্তা দিয়েছে বলে দাবি করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। অন্যদিকে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, তাদের বাহিনী ‘অসাধারণ’ সামরিক সাফল্য অর্জন করেছে। ইসলামাবাদের রাস্তায় উদযাপনে মেতে ওঠে স্থানীয় জনগণ। ভারতই যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে দাবি করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
দুই দেশের মিডিয়াগুলো পরস্পরের জয়কে বড় করে দেখাতে গিয়ে ফলাও করে প্রচার করতে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। তিনটি আধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমানসহ পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি করছে পাকিস্তানি পাইলটরা। অন্যদিকে, ভারত স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করে পাল্টা দাবি করছে, তাদের বিমান হামলায় পাকিস্তানের একাধিক সামরিক স্থাপনায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সংঘাতের অবসানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করছেন। যদিও ভারত এ দাবি খাটো করে দেখাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট উভয়পক্ষকে শান্ত থাকতে ফোন করেছিলেন বলে জানান। পাকিস্তান মার্কিন হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানালেও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে তাদের জাতীয় গর্ব ও অভ্যন্তরীণ নীতির অংশ হিসেবে দেখিয়েছে।
সিএনএন বলছে, সংঘাত স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, কাশ্মীর ইস্যুতে উত্তেজনা কেবল চাপা পড়ে থাকে, কিন্তু মিটে যায় না। উভয়পক্ষের বিজয়ের দাবির ভিড়ে পরাজয়টিই যেন ধ্রুবক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, ভূস্বর্গ কাশ্মীরের ভাগ্যে শুধুই অশ্রু আর সংঘাত।
এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে বন্ধে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি বিমানবন্দর খুলে দিয়েছে ভারত। এগুলোর মধ্যে শ্রীনগর, জম্মু, চন্ডিগড়, অমৃতসর, জয়সলমির, যোধপুর, জামনগর ভুজসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর রয়েছে। গতকাল ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, যে ৩২টি বিমানবন্দরকে ১৫ মে পর্যন্ত বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল, তা খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে বিমানযাত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনের সঙ্গে কথা বলে বা ওয়েবসাইটে তাদের আপডেট দেখেই বিমানবন্দরে যায়।
অন্যদিকে পাকিস্তান শনিবারই তার আকাশপথ খুলে দিয়েছে।
ভারতের সীমান্তবর্তী শহর অমৃতসারের বাসিন্দা ও চালক ধর্মেন্দ্র সিংহ জানান, এখানে তেমন ভয় নেই। জম্মুর মতো পরিস্থিতিও না। এখন সব শেষ... শহর আবার তার আগের রূপে ফিরছে, এটা দেখে ভালো লাগছে।