সম্প্রতি মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় পালনের ৮০তম বার্ষিকী কেবল একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান ছিল না; বরং একটি ভূরাজনৈতিক বার্তা বহন করেছে, যার তাৎপর্য নিছক প্রতীকীর বাইরে বিস্তৃত। অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উপস্থিতি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সাক্ষাৎ বর্তমান বৈশি^ক রাজনীতির একটি পুনর্গঠনের আভাস দেয়। যা গ্লোবাল সাউথের আকাক্সক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে। এ ধরনের অনুষ্ঠানকে খোলা চোখে অনেকে কূটনৈতিক প্রদর্শন বা পুরনো মিত্রতার প্রতি নস্টালজিয়া বলে ওড়াতে পারেন। কিন্তু এ রকম ভাবলে বাস্তবতা সম্পর্কে গুরুতর ভুল ব্যাখ্যা হবে। শি ও পুতিনের যৌথ বিবৃতিগুলো যা কৌশলগত সমন্বয়, আন্তর্জাতিক আইন ও বহুপাক্ষিকতাকে গুরুত্ব দেয়। এগুলো কেবল বক্তব্য নয়, বরং একটি গভীরতর অসন্তোষ ও সংস্কারের আহ্বান তুলে ধরে। একটি বিশ্বব্যবস্থা যা দীর্ঘদিন ধরে শক্তিকে নীতির ওপরে এবং অন্তর্ভুক্তির বদলে বর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার চীন ও রাশিয়া নিখুঁত ন্যায়বিচারের ধারক নয়। তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিও যথেষ্ট সমালোচিত। কিন্তু এখানে যে প্রক্রিয়াটি চলছে তা কোনো নৈতিকতার দ্বন্দ্ব নয়, বরং একটি শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যেখানে ১৯৪৫ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার বৈধতা সংকটের প্রতিকারে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস চলছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, ইরান পারমাণবিক চুক্তি এবং ইউনেস্কোর মতো বহুপাক্ষিক কাঠামো থেকে পরপর সরকারগুলো সরে এসেছে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এমনকি ন্যাটোর প্রতিও আমেরিকার সন্দেহভাব তৈরি হয়েছে, যার ফলে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই শূন্যতায় এখন বিশে^র বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর প্রবেশ ঘটছে। এই শূন্যতা গ্লোবাল সাউথের দৃষ্টিসীমার বাইরে নয়। আক্রা থেকে জাকার্তা পর্যন্ত নীতিনির্ধারকরা এখন এক পশ্চিমা নৈতিক কর্র্তৃত্বকে প্রশ্ন করছেন, যারা গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু বাস্তবে কৌশলগত দ্বিচারিতা করে। একতরফাভাবে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বা নির্বাচিতভাবে প্রয়োগ করা তথাকথিত ‘নিয়মভিত্তিক’ ব্যবস্থা এসব বাস্তবতা দেখায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য গঠিত হয়েছিল, সেগুলো প্রভাবশালীদের সুবিধায় অপব্যবহৃত হয়ে আসছে।
মস্কো থেকে ঘোষিত যৌথ বিবৃতিগুলো এই অসন্তোষের কেন্দ্রে আঘাত করে। সেগুলো জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে পুনঃনিশ্চিত করে, সার্বভৌম সমতার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকার করে যেসব নীতি গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ তাদের জন্য, যারা ইতিহাস জুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন, বলপ্রয়োগ অথবা অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছে। এই দেশগুলো বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে উল্টে দিতে চায় না; তারা শুধু চায় সেই ন্যায্য স্থানটি, যা তাদের প্রাপ্য। আমরা যেন এটিকে পুরনো শীতল যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ভেবে ভুল না করি। এটি অতীতের আদর্শিক মুখোমুখি অবস্থান নয়। আজ যা প্রত্যক্ষ করছি, তা হলো এক বহুমেরুকেন্দ্রিক সংশোধন একটি প্রয়াস, যা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ও বহুধারায় সমৃদ্ধ করতে চায়। চীনের নিজস্ব বৈশ্বিক কৌশল যেমন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা একটি যৌথ সমৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। গ্লোবাল সাউথ এই বাস্তবতাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে। চীনের অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে অনেক দেশ বাস্তব উপকার পেয়েছে। তারা চীনের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির মতো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না। তারা চীনকে দেখে এমন এক অংশীদার হিসেবে, যে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে আলোচনায় প্রস্তুত যেখানে শাসন পরিবর্তন, মতাদর্শ চাপানো, কিংবা কৌশলগত অধীনতা কোনো শর্ত নয়।
গ্লোবাল সাউথের সামনে দুটি পথ একটি কর্র্তৃত্ববাদী বিশ্বব্যবস্থা, যা বিনা প্রশ্নে আনুগত্য চায়, অন্যটি বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা, যা সংলাপ ও সম্মানের প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে পছন্দটা স্পষ্ট। আর এই সিদ্ধান্ত কোনো সহজ-সরল আবেগের কারণে নয়; এটি এসেছে অভিজ্ঞতার কঠোর বাস্তবতা থেকে। এখানেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ক্ষমতাধরদের খেয়ালখুশির খেলার মাঠ হিসেবে নয়, বরং একতরফা আধিপত্য রোধ করার গ্যারান্টি হিসেবে। আমরা এমন এক যুগে আছি, যেখানে প্রযুক্তিগত অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সম্পদ প্রবাহের দ্বন্দ্ব এবং পুনরুত্থিত মতাদর্শিক বিভাজন বাস্তবতা। সামরিক ঘাঁটির বিস্তার, একতরফা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, এমনকি মহাকাশের সামরিকীকরণ পর্যন্ত ইঙ্গিত দেয় বর্তমান নিরাপত্তা কাঠামো চাপে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থা শুধু কাম্য নয় এটি অপরিহার্য। চীন ও রাশিয়া একা নয়, এই পরিবর্তনের পক্ষে। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও আরও অনেক দেশ এখন বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার চাইছে। তারা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে চায়। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ চায়। তারা চায় আন্তর্জাতিক আইন যেন সমভাবে প্রযোজ্য হয়। এই বৃহত্তর অঙ্গনে গ্লোবাল সাউথ আর কোনো নীরব দর্শক নয়।
পশ্চিম বিশ্ব যদি প্রভাব ধরে রাখতে চায়, তাহলে তারা যা প্রচার করে, সেগুলো নিজেদেরও অনুশীলন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট শি যথার্থই বলেছেন ইতিহাস একটি আয়না। সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয় বিজয়, ভুলও। বিশ শতকের সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা ছিল, ক্ষমতা ভাগাভাগি না করার ব্যর্থতা। একবিংশ শতাব্দীর সুযোগ হলো সেই ভুল না করা। এই বৈচিত্র্যময় কাঠামোয়, গ্লোবাল সাউথকে আর প্রান্তে ঠেলে রাখা চলবে না। তাদের স্থান হতে হবে আলোচনার টেবিলে অতিথি হিসেবে নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ অংশীদার হিসেবে। এটাই সেই ভবিষ্যৎ, যার জন্য লড়াই করা সার্থক। এবং এটাই একমাত্র পথ, যাতে করে যে শান্তি অতীতের বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল, তা আর কখনো অহংকারের বিভ্রমে হারিয়ে না যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক