যখন কেউ বলেন, তিনি আরও পাঁচ বছর থাকবেন, তখন তার চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ থাকে। কিন্তু যখন শুনেন জনগণ একটি অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন চায়, তখন মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। চোখ-মুখ অতৃপ্ত হয়ে ওঠে। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। অভিব্যক্তিতে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ পায়। কেন? তাহলে কি নির্বাচনের কথা বলতে নেই! তিনি জানেন, একটি অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন হলে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তাই বিরক্ত হন। আর তখনই বলেন ‘জনগণ তো নির্বাচনের কথা বলে না’।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ভয়-ভীতির সংস্কৃতি রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনগুলোতে মানুষ তাদের ভোট দিতে পারেনি। তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে মানুষ প্রার্থী হতে পারেনি। মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ছিল না। গুম, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, হয়রানি এবং বছরের পর বছর জেলে থাকার ভয়ে মানুষ প্রতিবাদ করতে পারেনি। বাংলাদেশকে একটি ভয়-ভীতির রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। উন্নয়নের নামে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে, ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’ দর্শনের নামে, র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দা-আদালত-প্রশাসন-সংসদ-মিডিয়া ব্যবহার করে একটি ত্রাস-ভীতির সাম্রাজ্য তৈরি করা হয়েছিল। যারা এই ভয়-ভীতির রাজনীতিকে ভয় পায়, তারা নিশ্চুপ থাকে। যারা ভয় পায় না, তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। যারা চুপ হয় না, তারা খুন হয়, গুম হয়, নির্যাতিত হয়, হয়রানির শিকার হয়। যারা এসবের কিছুই তোয়াক্কা করে না, তারা দেশছাড়া হয়। যারা দেশ ছাড়ে না, তারা আয়নাঘরে পচে মরে এমনই ছিল প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা, কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন একদিকে যেমন স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ঘটিয়েছে, তেমনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়ার স্বপ্নকে জাগ্রত করেছে। তাই দেশের সব মানুষ এই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্মতি জানায়। এ গণআন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারী শাসনের অবসান, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন বজায় রাখা এবং দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হত্যা-ধর্ষণমুক্ত একটি সুশাসনের রাষ্ট্র বিনির্মাণ। কিন্তু তারপর কী হলো? মামলা ও চার্জশিটের কৌশল পাল্টেছে, প্রতিহিংসা পাল্টায়নি। নির্বাচন কমিশন পাল্টেছে, অনুগত আচরণ পাল্টায়নি। পদ্ধতি পাল্টেছে, উদ্দেশ্য পাল্টায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। কিন্তু সেই গণঅভ্যুত্থানে যারা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, যাদের পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের কোনো সুচিকিৎসা হয়নি, সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। হাজারো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ভয়-ভীতির সংস্কৃতিকে আরও গভীর করেছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মব ও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। হাসিনা সরকার পদত্যাগ ও পালানোর পর জনগণের একাংশ নিজেদের বিজয়ী মনে করে প্রতিহিংসার নানা ঘটনার জন্ম দেয়, যা আজ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ২৮ এপ্রিল ২০২৫, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে সরকার ‘মানবিক করিডর’ খোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নোবেলজয়ী এবং গণতন্ত্রের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ এই ব্যক্তি কীভাবে জনগণের মতামত বা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত সমর্থন করলেন এ প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, মানবিকতা বা কূটনীতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থ ও জাতীয় সম্মান। ১০ মে ২০২৫, অন্তর্বর্তী সরকার এক বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত নেয় যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-অঙ্গ সংগঠনের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। সংশোধিত আইনে দলটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুযোগ রাখা হয়েছে। সরকার বলছে, এই সিদ্ধান্ত সাময়িক এবং শুধু বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রযোজ্য। তবে এটি বাস্তবায়নের পদ্ধতি, সময়সীমা এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিবন্ধন বাতিল করে সরকার বিচার কার্যকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠলে, তা গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাতে পারে। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে; একই সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়ায় যেন ন্যায়নিষ্ঠতা দৃশ্যমান হয়, সেই তাগিদ দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই সংস্কার নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। ‘আগে নির্বাচন না আগে সংস্কার?’ এই প্রশ্ন আসলে একটি ফাঁদ, যা নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করাই উদ্দেশ্য। নির্বাচন এবং সংস্কার উভয়ই প্রয়োজন। একটি ছাড়া অন্যটি কার্যকর হয় না। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয় না। আবার নির্বাচন ছাড়া সংস্কার টিকে না। নির্বাচন না হলে, কোনো সংস্কার জনগণের ম্যান্ডেট পায় না। নির্বাচন না হলে, কোনো সংস্কার বাস্তবায়ন হয় না। নির্বাচন না হলে, কোনো সংস্কার জবাবদিহির আওতায়ও আসে না। নির্বাচন জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি। তাই প্রথমে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করা জরুরি। এই সংস্কার নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে, সংসদকে কার্যকর করে তুলবে, সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনবে এবং বিরোধী দলের জন্য অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই সংস্কার জনগণের অধিকার রক্ষা করবে, গণমাধ্যম ও নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কায়েম করবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। এই সংস্কার রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিকে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।
ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে বড় দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতিমধ্যেই বলেছেন ‘সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বৈধ, নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।’ এ কথা সত্য। কোনো অনির্বাচিত সরকার, কোনো একদলীয় সরকার, কোনো নির্বাচনবর্জিত সরকার সংস্কার করতে পারে না; সে যতই মানুষের আকাক্সক্ষা বা সমর্থনে গঠিত হোক। জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থনই একমাত্র যেকোনো নির্বাচিত সরকার বা প্রতিনিধিকে আইনসংগত করে। কারণ সংস্কার মানে শুধু আইন পরিবর্তন নয়, মানসিকতার পরিবর্তন, প্রশাসনের সংস্কৃতি পরিবর্তন এবং সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের সম্মতি। এই জনগণের সম্মতিই একমাত্র নির্বাচন থেকেই পাওয়া সম্ভব। প্রফেসর ইউনূস সরকারের কিছু সফলতা আছে, তবে ব্যর্থতা হলো, তারা এখনো পর্যন্ত একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে পারেনি। তারা এখনো পর্যন্ত এই নির্বাচন কখন, কীভাবে, কী পদ্ধতিতে হবে, সেটা নিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কোনো রূপরেখা দিতে পারেনি।
বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট দূর করতে পারেনি। জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে এই নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারেনি। নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তিকর অবস্থান গ্রহণ করেছে, যা আবারও ভয়-ভীতির সংস্কৃতি শক্তিশালী করছে। এসব কারণেই, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যের সময়সীমার মধ্যে আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ সংশয় শুরু হয়ে গেছে। সেটা রাজনৈতিক দল বা নাগরিক সব পর্যায়ে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বা প্রাণ হলো জনগণের ভোটাধিকার। জনগণই নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তাদের নীতিমালা নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের বৈধতা নির্ভর করে জনগণের ভোটের ওপর। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয় ও পরিবর্তিত হয়। গণতন্ত্রে এই ভোট শুধু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; এটি জনগণের অধিকার রক্ষা, প্রয়োগ নিশ্চিত করার যৌথ অংশীদারত্ব। জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হলে জনতাই ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি পরিবর্তন করে পুনরায় তাদের কাক্সিক্ষত প্রতিনিধি বা সরকার নির্বাচিত করে এটাই গণতন্ত্রের চিরাচরিত ধারা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী এবং তাদের মতামতই শেষ কথা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট অধিকার প্রয়োগ করে এবং রাষ্ট্রীয় সব কাজে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের সব সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র জনগণ।
জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার টেকসই হতে পারে না, হবে বলেও মনে হচ্ছে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা একটি সময়োপযোগী এবং অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখের ঘোষণা শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আনবে না, বরং জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের কাজও করবে। আর এভাবেই জনগণ রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারে মূল কারিগর হিসেবে ভূমিকা রেখে চলমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সব কর্মকাণ্ড অগ্রসর করে নেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে