সুন্দরবনে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় প্রাণের উপস্থিতি। যার ওপর নির্ভর করছে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। একবারও কি ভেবেছি, সুন্দরবন না থাকলে উপকূলবর্তীসহ দেশের মানুষের জীবনের কী হবে! শুধু জীবন-জীবিকাই নয়, যুগ যুগ ধরে এই সুন্দরবন ঢাল হয়ে ঘূর্ণিঝড়সহ অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশকে রক্ষা করে যাচ্ছে। যার অর্থনৈতিক মূল্য কল্পনার বাইরে। দীর্ঘ সময় ধরে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় সব ধরনের শিল্পায়ন বন্ধের জোর দাবি জানাচ্ছেন বিশিষ্টজনরা। অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এবং বাংলাদেশের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বলছেন শিল্পকারখানার আগ্রাসনে ধ্বংসের মুখে রয়েছে সুন্দরবন। কিন্তু বিগত সরকার এ বিষয়ে কোনো ‘রা’ করেনি।
বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে চারপাশ ঘিরে ভারী শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কেনার হিড়িক পড়েছে অনেক আগেই। ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০ শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আশপাশের গ্রামগুলোতে ১০ হাজার একর জমি কিনেছেন। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন না করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই আদেশে কেউ কর্ণপাত করেননি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নেতারা অতীতে অনেকবার বলেছেন প্রভাবশালী মহলের অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পদূষণে আক্রান্ত সুন্দরবন। তারা এমনও বলেছেন সুন্দরবনের আশপাশে সব ধরনের শিল্পায়ন বন্ধ করতে হবে। বনের চারপাশের মানুষের জন্য শিক্ষা ও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। লাভ হয়নি। ফলে ক্রমাগত দূষণ বাড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে। বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনের কারণে হয়েছে দূষণ।
সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ৭৮৯তম বিশ্বঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এই বন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। সুন্দরবন বায়ুম-লের কার্বন ধরে রেখে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমিত করে ও পরিবেশ সংরক্ষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে দেশ রূপান্তরে মঙ্গলবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যে খবরটি আপাতভাবে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। জানা যাচ্ছে- সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সোমবার এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে ইসিএ ঘোষণার আলোকে ওই অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে। ২০১৭ সালে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে গঠিত ইসিএ সীমানা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু শিল্প প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাতীয় পরিবেশ কমিটির বৈঠকে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের ভেতরে শিল্পের অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও পরিবেশবাদীরা তখন বলেছিলেন, শিল্পকারখানা সুন্দরবনকে সংকটে ফেলবে। কোনো লাভ হয়নি। অর্থলোভী, আগ্রাসী সেই অপশক্তি বিগত সরকারের প্রশ্রয়ে তাদের কাজ করে গেছে নির্ভয়ে, বিনা বাধায়।
বিগত সরকারের সময় সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মধ্যে কতগুলো শিল্পকারখানা রয়েছে তার তালিকা দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর আদালতের নির্দেশ মোতাবেক সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তর হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে। অবশেষে কী খবর হয়েছে, তাও আমাদের জানা নেই। এই সুন্দরবনই দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস। সব দূষিত বায়ু নিয়ে সুন্দরবন আমাদের নির্মল বায়ু উপহার দিচ্ছে। বাঁচিয়ে রাখছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে। শুধু মানুষ নয়, অসংখ্য প্রাণ নির্ভয়ে রয়েছে এই অভয়ারণ্য ঘিরে। তাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, আমাদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি।