শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

যুদ্ধের অস্ত্র ‘ক্ষুধা’

আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ০৪:২৮ এএম

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকার প্রায় পুরোটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে শরণার্থীশিবির ও তার আশপাশের অঞ্চলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাজায় ত্রাণের স্বল্পতা। দুই মাস ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকাটিতে খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। ফলে সেখানে মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। গাজায় বসবাসরত প্রায় ২১ লাখ ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়নবিষয়ক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধের মুখে ত্রাণ ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা ঢুকতে না পারার কারণে সেখানকার বাসিন্দারা ‘চরম খাদ্য সংকটের’ মুখোমুখি হচ্ছেন বলেও এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংস্থাটি।

ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন বা আইপিসি মূলত জাতিসংঘ, দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি সংস্থা, যাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহল একটি এলাকায় দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে কি-না, সেটির প্রাথমিক মূল্যায়ন করে থাকে। গত সোমবার প্রকাশিত আইপিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরের পর থেকেই গাজার খাদ্য পরিস্থিতিতে বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। বর্তমানে সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু না হলেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে নতুন করে বৈরিতা গাজাবাসীকে আবার উদ্বিগ্ন করে তুলছে। বিশেষ করে, গত মার্চের শুরু থেকে মানবিক সহায়তা প্রবেশে ইসরায়েলের অব্যাহত বাধা পরিস্থিতিতে আরও জটিল করে তুলেছে।

প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, বর্তমানে গাজার প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ অবস্থায় দুর্ভিক্ষের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আইপিসি। গত মার্চ মাসের মধ্যভাগ থেকে গাজায় আবারও অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। ইসরায়েল বলছে, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে এখনো যেসব নাগরিক জিম্মি রয়েছে, তাদের মুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই তাদের এই পদক্ষেপ। যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল ইসরায়েলের এই অব্যাহত অবরোধের বিরোধিতা করে নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, গাজা সীমান্ত তারা ইতিমধ্যেই মানবিক সহায়তা সামগ্রী প্রস্তুত রেখেছে। ইসরায়েল বাধা না দিলেই সেগুলো দ্রুত ঢুকে যেতে পারবে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ত্রাণ সহায়তার ওপর ইসরায়েলের অব্যাহত এই অবরোধ এবং গাজাবাসীকে ‘অনাহারে রাখার নীতি’ যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। আইপিসি প্রকাশিত সবশেষ মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, গাজার প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ অনাহারের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০২৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১১ মাসে সেখানকার পাঁচ বছরের কমবয়সী প্রায় ৭১ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়নবিষয়ক সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যাভাবের কারণে গাজার অনেক পরিবার বিভিন্ন ধরনের চরম পদক্ষেপও নিচ্ছে। কেউ কেউ ভিক্ষা করা শুরু করেছে, অনেকে ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) জানায়, অক্টোবরের তুলনায় পরিস্থিতির এই অবনতি বিশ্বব্যাপী সংঘাতে ঘেরা অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের প্রতিফলন। এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন (১৯ লাখ ৫০ হাজার) মানুষ অথবা গাজার জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরের মধ্য দিয়ে বাস করছে। যার মধ্যে ২ লাখ ৪৪ হাজার জন ‘বিপর্যয়কর’ স্তরের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা রিফ পিপারকর্ণ সতর্ক করে বলেছেন, খাদ্যের অভাব গাজার শিশুদের পুরো একটি প্রজন্মের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অবশ্য গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার বিষয়টি মানতে নারাজ। তারা দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতির সময় সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী প্রবেশ করেছে। এদিকে, হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, গাজায় খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য মানবিক সহায়তা যেন ঢুকতে দেওয়া হয়, সেজন্য তারা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। সোমবার এডান আলেকজান্ডার নামে আমেরিকান-ইসরায়েলি নাগরিক একজন জিম্মিকে মুক্তিও দিয়েছে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। তাকে গাজায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের হাতে তুলে দেয় তারা। প্রায় ৫৮০ দিন হামাসের হাতে জিম্মি থাকার পর নিজ পরিবারের কাছে ফিরলেন আলেক্সান্ডার। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আলেকজান্ডারের মুক্তির পরিবর্তে তারা শুধু একটি ‘নিরাপদ করিডর’ দেওয়া কথা ভাবছে বলেও জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল মধ্যপ্রাচ্যে সফরে গেছেন। ট্রাম্পের এই সফরকালে কোনো চুক্তিতে না পৌঁছালে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের বর্ধিত আক্রমণ পরিকল্পনার মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার সব এলাকা দখল করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া গাজাবাসীকে জোর-পূর্বক বাস্তুচ্যুত করে দক্ষিণে পাঠানোর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে নেবে ইসরায়েল। যদিও জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, এটি বাস্তবায়ন হলে মানবিক সহায়তা সামগ্রীকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ইসরায়েল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলায় প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। গত দেড় বছরে জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকদের অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন। তবে এখনো প্রায় ৫৯ জন জিম্মি হামাসের হাতে জিম্মি রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জনের মতো জীবিত রয়েছেন। গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, এরপর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছে গাজার অন্তত ৫২ হাজার ৮৬২ জন বাসিন্দা।

গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত : যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ চলছেই। গতকালও গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের হামলার শিকার হয়েছে খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স। হাসপাতালটিতে হামলায় হাসান ইসলায়া নামের এক সাংবাদিকসহ দুজন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন রোগী গুরুতর আহত হয়েছে।

উপত্যকাটিতে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা চলমান আছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। গতকাল আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, কাতারের দোহায় এ বিষয়ে হামাস ও ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। জিম্মিদের পরিবারকে উইটকফ বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন এই আলোচনা থেকে ইতিবাচক কিছুই আসবে। অন্যথায় তারা এতটা পথ ভ্রমণ করতেন না বলেও মন্তব্য করেন উইটকফ। জিম্মিদের পরিবার ও সংগঠনের বরাত দিয়ে ইসরায়েলের গণমাধ্যমে এ খবর জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের একটাই লক্ষ্য, প্রতিটি জিম্মিকে মুক্ত করা। এই মধ্যস্থতায় বড় ভূমিকা পালন করছে কাতারও। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিনিধির বরাত দিয়ে ভার্জিনিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মাদ বিন আব্দুলরাহমান আল থানি হামাসকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন। তার অংশ হিসেবেই জিম্মি এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই জিম্মি মুক্তির বিষয়ে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন প্যালেস্টাইন-আমেরিকান ব্যবসায়ী বিশারা বাবাহ, যিনি ট্রাম্পের মিত্র হিসেবে পরিচিত।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত