বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সুরা হুমাজায় কৃপণতা ও পরনিন্দার ভয়াবহতা

আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ০২:৪৭ এএম

জিহ্বা মানুষের চরিত্রের আয়না। এই ক্ষুদ্র অঙ্গটির সদ্ব্যবহার যেমন কাউকে জান্নাতে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি অপব্যবহার তাকে জাহান্নামের অতল গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে। পরনিন্দা, গিবত, চরিত্র হনন ও কটুবাক্য মানবজাতির সেই নোংরা অভ্যাসগুলোর অন্তর্গত, যেগুলোর ভয়াবহতা আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই। অথচ পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে এসব বদ অভ্যাসের বিরুদ্ধে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। সুরা হুমাজা সেটার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

সুরা হুমাজা কোরআনের ১০৪তম সুরা, মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত সংখ্যা ৯টি। আয়াতের পর আয়াতে ফুটে উঠেছে নিন্দুক, কৃপণ ও দুনিয়ামুখী মানুষের পরিণতির ভয়াল চিত্র। এখানে মহান আল্লাহ এমন এক শ্রেণির মানুষের আলোচনা করেছেন, যারা মানুষের দোষ তালাশ করে, সম্পদ নিয়ে গর্ব করে এবং মনে করে এই পার্থিব ধন-সম্পদই তাকে অনন্ত জীবন দেবে। তাদের সেই মিথ্যা মোহ ও আত্মঅহংকারের করুণ পরিণতি হলো ‘হুতামা’ নামক এক ভয়াবহ জাহান্নাম, যার আগুন হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যেখানে থাকবে অবিরাম শাস্তি।

আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় আমরা দেখি গিবত, কটূক্তি, চরিত্র হননের মতো পাপ কাজ যেন এক ধরনের সামাজিক বিনোদনে পরিণত হয়েছে। একই ভাবে ধন-সম্পদ নিয়ে গর্বিত হয়ে বহু মানুষ আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কৃপণতা করছে। এই সুরা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পৃথিবীর জীবনে যা মূল্যবান বলে মনে হয়, তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ না হয়, তবে তা পরকালে ভয়াবহ ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সুরাটির বার্তা হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের উচিত জিহ্বাকে সংযত করা, হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করা এবং সম্পদকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলেই পরিত্রাণের পথ সুগম হবে।

সুরা হুমাজার অনুবাদ উল্লেখ করা হলো। এক. দুর্ভোগ ও ধ্বংস ওই ব্যক্তির জন্য, যে সামনে-পেছনে মানুষের নিন্দা করে। দুই. যে সম্পদ জমায় এবং তা বারবার গণনা করে। তিন. সে ধারণা করে যে তার ধন-সম্পদ তাকে অমর করে রাখবে। চার. কখনোই নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়। পাঁচ. হে নবী! আপনি কি জানেন হুতামা কী? ছয়. হুতামা আল্লাহর প্রজ¦লিত আগুন। সাত. যা মানুষের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। আট. নিশ্চয়ই এটা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে। নয়. দীর্ঘায়িত স্তম্ভে।

হুমাজা ও লুমাজা : এ সুরায় বর্ণিত হুমাজা ও লুমাজা ভিন্ন নাকি অভিন্ন, এ ব্যপারে মুফাসসিরদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হুমাজা গিবতকারী আর লুমাজা ছিদ্রান্বেষী। আতা (রহ.)-এর মতে হুমাজা ওই ব্যক্তি, যে মুখের ওপর মানুষের নিন্দা করে। খোঁচা মারে। আর লুমাজা হলো কারও অনুপস্থিতিতে নিন্দা করা। কাতাদা (রহ.)-এর বর্ণনা মতে, চোখের ইশারা-ইঙ্গিতে মানুষের দোষ বর্ণনা করার নাম হুমাজা আর জিহ্বা দিয়ে খারাপি বর্ণনা করা লুমাজা। (জাদুল মুয়াসসার) নিন্দার মাধ্যমে যারা অন্যকে কষ্ট দেয় তারাই এই আয়াতে উদ্দেশ্য। যা এই সুরার প্রথম আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

সম্পদ জমানো : আলোচ্য সুরার দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সম্পদ অর্জনের নেশায় মত্ত থাকা। আমাদের সমাজে এমন মানুষের অভাব নেই যারা পাহাড় সমান সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর দেখানো পথে ব্যয় করে না। তারা সম্পদ জমায় আর জমায়। ইমাম ইকরিমা (রহ.)-এর বর্ণনা মতে, যারা সম্পদ গণনা করে ও জমা করে, তাদের জন্যও ‘ওয়াইল’ নামক জাহান্নাম রয়েছে। (জাদুল মুয়াসসার ৪/৪৮৯)

এমন ব্যক্তি সম্পদ শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আল্লাহর বর্ণিত যথাযথ খাতে সম্পদ ব্যয় করে না। কিছু সম্পদশালী ব্যক্তি এমন আছেন যারা ধারণা করে যে তার ধন-সম্পদ তাকে অমর করে রাখবে। সম্পদের বলে অনন্তকালের জন্য বেঁচে থাকবে। মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। দৈনন্দিন জীবনে সে এমন কর্মকাণ্ড করে যা দেখে মনে হয় মৃত্যু তাকে ধরতে পারবে না। তাফসিরে তাবারিতে এসেছে, ‘তারা ধারণা করে যে সম্পদ তারা হিসাব করে জমিয়েছে, তা তাদের দুনিয়ায় চিরস্থায়ী করবে। তার থেকে মৃত্যুকে দূর করবে।’

দুনিয়াতে কি কখনো এমন হয়েছে যে সম্পদের কারণে কেউ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে? এমনটা কখনো হয়নি আর হবেও না। বরং সম্পদের পূজা তাকে জাহান্নামের নিকৃষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবে। তার চূড়ান্ত ধ্বংস নিশ্চিত করবে।

হুতামার ভয়াবহতা : সম্পদের পূজারীদের হুতামায় নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নামের এই অংশকে ‘হুতামা’ বলা হয় কেন, তাফসিরে মাতুরিদির বর্ণনায় এসেছে, হুতামা একটি জাহান্নামের নাম। এই তার নামকরণ হয়েছে, কারণ যে-ই সেখানে নিক্ষিপ্ত হবে, সেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হবে। হাড্ডি থেকে গোশত খাওয়ার পর আমরা হাড্ডিগুলোকে যেভাবে দাঁতে পিষে ফেলি, টুকরা টুকরা করে ফেলি, এই জাহান্নামে যারা নিক্ষিপ্ত হবে তাদের অবস্থাও তেমনি হবে। আবার কেউ বলেন, সম্পদ পূজারীরা তাদের সম্পদসহ এই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

আগুন হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে : হুতামার বর্ণনায় আল্লাহ বলেছেন, ‘হুতামা আল্লাহর প্রজ¦লিত আগুন। যা মানুষের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে।’ এই আগুন ব্যক্তির চামড়া, গোশত, হাড্ডি সব জ্বালিয়ে খেয়ে ফেলবে। একটা পর্যায়ে তা জাহান্নামির হৃদয় অবধি পৌঁছাবে এবং তার অন্তরকেও জ্বালাবে। ইমাম ফাররার মতে দহনের কষ্ট ব্যক্তির অন্তর অবধি পৌঁছবে। আয়াতে অন্তরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ অন্তরের কষ্ট ব্যক্তিকে মরণ অবধি পৌঁছে দেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় জাহান্নামে মরণ থাকবে না। যার কারণে অনন্তকালের জন্য কষ্টের অনলে দহন হতে হবে (তাফসিরে তবারি ৩৪/৬২৩)

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত