ভারতবর্ষের ইতিহাসে মোগল শাসকদের অবদান কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যকলায়ও তারা এক অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বিশেষ করে মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলী আজও ইতিহাসপ্রেমী ও সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন মানুষের হৃদয়ে বিস্ময় জাগায়। দিল্লির লাল কেল্লা, আগ্রার তাজমহল, লাহোরের বাদশাহি মসজিদ কিংবা বাংলার ষাটগম্বুজ মসজিদ, প্রতিটিই এক একটি নিপুণ কারিগরি ও স্থাপত্যকৌশলের বিস্ময়কর নিদর্শন। এসব স্থাপত্যে ধর্মীয় আবেগ, নান্দনিক সৌন্দর্য ও কৌশলগত দৃঢ়তা পাশাপাশি বিরাজ করে। এই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণবঙ্গের এক প্রান্তে গড়ে উঠেছিল একটি তুলনামূলক ছোট অথচ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবিচিনি শাহি মসজিদ। বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি ইউনিয়নে অবস্থিত এই মসজিদটি মোগল আমলের এক অপূর্ব নিদর্শন। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে বাদশাহ শাহজাহানের শাসনামলে পারস্য থেকে আগত আধ্যাত্মিক সাধক শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.) এ মসজিদ নির্মাণ করেন। যদিও এর আয়তন বিশাল নয়, তবু স্থাপত্যশৈলীতে মোগল রীতির পরিপূর্ণ ছাপ ফুটে উঠেছে।
এই মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়; বরং দক্ষিণবঙ্গে ইসলাম প্রচারের এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র ছিল। গম্বুজঘেরা এ কাঠামো কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে সবুজে মোড়া এক উচ্চ টিলার ওপর। স্থাপত্যরসিক, ইতিহাসানুরাগী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এটি এক অনন্য গন্তব্য। এই নিবন্ধে বিবিচিনি শাহি মসজিদের ইতিহাস, স্থাপত্যরীতি এবং এর চারপাশে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতির আলোকে বিবরণী উল্লেখ করা হলো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আধ্যাত্মিক সাধক শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.) প্রাচীন পারস্য (বর্তমান ইরান) থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে দিল্লিতে আগমন করেন। সে সময় সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ও বঙ্গদেশের সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.) বজরায় চড়ে গঙ্গা অববাহিকা অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে (বর্তমান চন্দ্রদ্বীপ) নোঙর করেন। দিল্লিতে আসার তিন-চার বছরের মাথায় শাহ সুজার আগ্রহে কয়েকজন শিষ্য সঙ্গে নিয়ে নেয়ামত উল্লাহ (রহ.) আসেন বেতাগীর এ গ্রামে। তখন এ গ্রামের নাম বিবিচিনি ছিল না।
তখন সুবাদার শাহ সুজার অনুরোধে এ গ্রামেই তিনি এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে সাধক নেয়ামত উল্লাহ (রহ.)-এর কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওই গ্রামের নামকরণ করা হয় বিবিচিনি এবং মসজিদটির নাম রাখা হয় বিবিচিনি শাহি মসজিদ। শাহ নেয়ামত উল্লাহর (রহ.)-এর নামের সঙ্গে মিল রেখেই বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নামকরণও করা হয় নেয়ামতি। এক সময় অঞ্চলটি ছিল মগ-ফিরিঙ্গিদের আবাসস্থল। তাদের হামলার প্রতিরোধে মসজিদটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৭০০ সালে হজরত শাহ নিয়ামত উল্লাহ (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তাকে এ মসজিদের পাশেই সমাহিত করা হয়।
এ স্থাপত্যের আয়তন খুব বিশাল না হলেও স্থাপত্য রীতিতে মোগল ভাবধারার ছাপ সুস্পষ্ট প্রতীয়মান। দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝখানে প্রায় ৪০ ফুট সুউচ্চ টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিবিচিনি শাহি মসজিদের ভবনটির উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। বর্গাকার এ মসজিদের দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। চারপাশের দেয়ালগুলো ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। দক্ষিণ ও উত্তরদিকে মোট তিনটি করে দরজা আছে।