মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

দুর্নীতিই দুর্নীতির উৎস

আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ১২:২৮ এএম

বৈষম্য এবং দুর্নীতি পরস্পরের পরিপূরক। একে অন্যের উপায় ও উপলক্ষ। বিস্ময়কর মনে হলেও, খোদ দুর্নীতির সংজ্ঞা সন্ধানেও দুর্নীতি হতে পারে। যে ব্যাখ্যা নিজের মনঃপূত নয়, যে বয়ান নিজের ভেদবুদ্ধি-জ্ঞানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, যে বর্ণনায় নিজের ধ্যান-ধারণারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় না সংজ্ঞায়নে সুকৌশলে তা এড়িয়ে চলাও এক ধরনের দুর্নীতি।

চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যে কর্মকান্ড নৈতিকতা-বিবর্জিত, সুশাসন, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি যেখানে যবুথবু অবস্থায়, যা সম্পাদনের দ্বারা অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিবেশ সৃষ্টি  হয় তাই দুর্নীতি। সুতরাং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (কজ অ্যান্ড ইফেক্ট) উভয়ের মধ্যেই দুর্নীতির উপস্থিতি লক্ষণীয়। চিন্তা-ভাবনায়, পরিকল্পনায়, সম্পাদনে, ফলাফলে প্রতিক্রিয়ায় সর্বত্র ন্যায়নীতি-নির্ভরতার অনুপস্থিতির মধ্যেই দুর্নীতির আদি অকৃত্রিম অধিবাস। দুর্নীতি শুধু দৃশ্যমান অন্যায়-অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, তহবিল তছরুপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্পদের  অপচয়, প্রতারণায় সীমাবদ্ধ নয় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকেও দুর্নীতির এখতিয়ারভুক্ত করার বিধান রয়েছে। যে পরিবেশে দুর্নীতি সংঘটিত হয়ে থাকে সেই পরিবেশকে এবং সেই পরিবেশ সৃজনকারীকেও দুর্নীতির এজাহারভুক্ত করা যেতে পারে। ল্যাটিন corrumpere  এর past participle ‘corruptus’ ’ শব্দ থেকে মধ্যযুগে ইংরেজি corruption শব্দটির উৎপত্তি ও বিবর্তন ঘটেছে। corrupt এর অর্থ অপব্যবহার আর  rumpere  এর অর্থ প্রচন্ডভাবে বা গভীরভাবে আঘাত অর্থাৎ প্রচন্ডভাবে বা তীব্রতার সঙ্গে কোনো কিছুর ক্ষতিসাধনই corruption বা দুর্নীতি। সংস্কৃত  তদ্ভব (দুর+নীতি) শব্দ উদ্ভূত ‘দুর্নীতি’, যা ‘নীতি’কে ‘দূর’ বা ফারাক করে দেয়। সুতরাং নীতি ও নৈতিকতার অভাবে ভৌত ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, অপচয়, অপব্যয়, আত্মসাৎ তছরুপ, চিন্তা-কর্মে ধ্যানে-জ্ঞানে অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ সবই দুর্নীতি। দুর্নীতির বুৎপত্তিগত বিস্তার ব্যাপক যেমন প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার, প্রচলিত নৈতিক ধ্যান-ধারণাকে এড়িয়ে চলা, মানসিকভাবে প্রতিবন্ধিত্ব বরণ, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব, চিন্তা-ভাবনায় একদেশদর্শিতা, অসদাচরণ, অসততা, অসাধুতা, অমিতাচার, অনুচিৎ, অশোভন, অসমীচীন, অন্যায়, দলীয়করণ ও পক্ষভুক্তকরণ, নিষ্ঠুর আচরণ, ন্যায়বিরুদ্ধতা সবই দুর্নীতির সংসারে শরিকানাভুক্ত।

মানবজীবনে দুর্নীতির সূত্রপাত সেই স্বর্গবাসের কাল থেকে। আদি পিতা-মাতা শয়তানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিধাতার নির্দেশনা অমান্য করেছিলেন। বোধি (জ্ঞান)  বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার মতো অবৈধ কাজের প্রতি তাদের মনে আগ্রহের বীজ বপন করে দিয়েছিল যে শয়তান (মন্দ প্রবণতা) সে এখনো সক্রিয়, সর্বদা-সর্বত্র তার তৎপরতা। বৈধতার চেয়ে অবৈধতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র সর্বজনীন। আর এই  ষড়যন্ত্রের ফাঁকে পা দেওয়াই দুর্নীতি। মানুষের অস্থিমজ্জায় প্রবাহিত খারাপ প্রবণতা সুযোগ পেলে অবৈধতার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। মানবমনে নৈতিক ও অনৈতিক শক্তির নিরন্তর লড়াই চলছে। নৈতিকতার শক্তি পরাস্ত হলে অনৈতিক পক্ষ বিজয়ী হয় ফলে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নৈতিকতার শক্তিকে সাহস জোগাতে, প্রবল করতে যুগে যুগে ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, আইনকানুন, নানান উপায় ও উপলক্ষ নির্মাণ করে চলেছে। আইনের শাসন, বিবেকের আদালত, সুশাসন ও জবাবদিহির সু¯’ পরিবেশের প্রভাব যেখানে বেশি সজ্ঞান-সক্রিয়, সেখানে দুর্নীতি কম। আবার যেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন সেখানে দুর্নীতি বেশি। বর্তমান বিশ্বে যেসব দেশে ও অঞ্চলে  সরকারি সম্পদ-সম্পত্তি-সৌভাগ্য ‘ভাগাভাগির’ অর্থনীতি, ‘আত্মসাৎ অপব্যয়ের’ অর্থনীতি-আর্থিকসহ নানান, রাজনৈতিক উৎকোচের ‘কেলেঙ্কারির’ অর্থনীতি যুগপৎভাবে বেগবান ও বিদ্যমান সে সব সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিষবাষ্প বা দুর্নীতির দুষ্টচক্র নানান পরিচয়ে পরিব্যাপ্ত। আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে এর সামাজিক বিস্তার।

‘জনগণের জন্য’, ‘জনগণের দ্বারা’ নির্বাচিত ‘জনগণের সরকার’ এ ধারণা ও দর্শনে  জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রেও এটিই সাফ কথা। এ নীতিবাক্যের আলোকে  জনগণের সম্পদ, দেশ ও অর্থনীতির সার্বভৌমত্বসহ সব স্বার্থ, নিরাপত্তা ও অধিকার, ক্ষমতা সবই সংরক্ষণের দায়িত্ব যেমন সরকারের ওপর বর্তায় তেমনি দায়িত্বশীল আচরণের দায়দায়িত্বও জনগণের। নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলীয় সরকার দলমত নির্বিশেষে সব পক্ষের হয়ে যায়, ‘কোনো প্রকার রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী’ হয়ে কোনো কর্মকান্ড পরিচালনা না করার শপথ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে যায়। সেই শপথের ব্যত্যয়ে সব জনগণের সম্পদ ও স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব পালনে অপারগ পরিবেশ পরিস্থিতিতে সরকার রক্ষক থেকে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে তা তুল্য হয় মহাদুর্নীতি (grand corruption)-এর সঙ্গে। সে পরিস্থিতিতে  গণতন্ত্রের মৌলিক মর্মমূলে আসে আঘাত। সাম্প্রতিক বিশ্বে কয়েকটি ছোট-বড় দেশে, অঞ্চলে ও অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নির্বাচিত কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকার। এসব সরকার নিজেই কলাকৌশলে দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চলে গেছে। আমজনতার অর্থনীতিতে ভাগ বসিয়েছে আত্মসাতে উন্মুখ দুর্নীতিবাজ নীতিনির্ধারক, জনগণের ভাগ্য বিধায়ক সরকার। তাদের সাফল্যসমূহ ম্লান হয়ে গেছে সীমাহীন দুর্নীতিতে, সেখানে ব্যাহত হয়েছে উন্নয়ন আর নানান নেতিবাচক মনোভাব এসে চিড় ধরিয়েছে জনগণের আস্থায়। এমন পরিস্থিতিতে কোথাও কোথাও উদ্ভব হয়েছে ভিন্ন পথ ও পন্থার। দেখা গিয়েছে যতগুলো কারণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পথ ও পন্থার সরকারের পতন বা পরিবর্তন ঘটেছে তাদের দুর্নীতিই বরাবরই শীর্ষ কারণ হিসেবে সামনে এসেছে।

দুর্নীতি নানান উপায়ে, প্রকারে ও ক্ষেত্রে হতে পারে। ছোটখাটো ব্যাপারে অন্যায় অনিয়মকে না দেখার ভান করে প্রশ্রয় দিয়ে, সামান্য পারিতোষিক আদান প্রদানের মাধ্যমে, দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার দ্বারা পুঁচকে প্রকৃতির দুর্নীতি (petty corruption) হয়ে থাকে, আর ব্যাপক আকারে বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা অর্থের, আত্মসাৎ অবৈধ অর্জন কিংবা তছরুপের দ্বারা মহাদুর্নীতি সম্পাদিত হয়ে থাকে। আর যদি সময় ও সমাজে নানান নিয়মকানুনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যে দুর্নীতি তা পদ্ধতিগত দুর্নীতি। বিশ্বাস, ধারণা চিন্তা-চেতনায় দুরভিসন্ধি এঁটে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিত্ব  বরণ করে যে দুর্নীতি তা নৈতিক দুর্নীতি (moral corruption) সালিশ বা বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে যে দুর্নীতি তা আইনের দুর্নীতি (legal corruption)। এ সব ধরনের দুর্নীতির মধ্যে আছে আন্তঃসংযোগ, রয়েছে পরস্পর প্রযুক্ততাও।

রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’-এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোনো অর্থবিত্তকে কালো টাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ সেটাই সাংবিধানিকভাবে বেশি যৌক্তিক। এর আলোকে দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ বেড়াজাল থেকে আইনের আওতায় ‘মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর সুশীল সেবক (আমলা) এবং মুনাফাবাজ/কালোবাজারি/চোরাকারবারি/ব্যাংকঋণ লুটেরা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের’ অপরাধের শাস্তি বিধান করা হলে সমাজে ও অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক মেসেজ যাবে। জরিমানা ছাড়া, অত্যন্ত হ্রাসকৃতহারে কর প্রদানের সুযোগ এবং ‘অর্থের উৎস নিয়ে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবেন না’ জাতীয় বিধান জারি বলবৎ থাকলে দেশ সমাজ ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিত্জ-এর কনসেপ্ট ‘নৈতিক বিপদ’-এর উপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে।

অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ কষ্টার্জিত নয়। কোনো সম্পদ সৃষ্টি কিংবা সেবার বিনিময়ে এটি অর্জিত হয় না বিধায় এই টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও চাহিদা সরবরাহ উপযোগিতা বাছবিচার চলে না বলেই এই অর্থ অবাধ খরচের ফলে মূল্যবৃদ্ধির কারণ ঘটিয়েও আর্থসামাজিক ভারসাম্যে ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকে। সমাজে অবৈধ আয়ের অর্থ অধিক ব্যয়ের চাকচিক্য সীমিত আয়ের মানুষদের কাছে দুঃসহ যন্ত্রণা ও মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতে অবৈধতার প্রতিযোগিতার পরিবেশে খেসারত দিতে হয় নীতি ও নৈতিকতার মূল্যবোধকেই। এক সময় হাতেগোনা গুটিকয়েক লোক হয়তো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হতো, সংখ্যাগুরু নীতিবানরা সবাই তাদের ঘৃণা করত, কিন্তু ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিবাজের মিছিল বড় হয়ে নীতিবানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে ‘Bad money drives away good money from the market’ এই থিওরিতে পরিস্থিতি এমনভাবে মোড় নিতে পারে যে নীতি ও নৈতিকতা একঘরে হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে, একটি দপ্তরে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়ায় যারা থাকেন তারা সবাই উপরির অর্থ সমানভাবে নিতে বা পেতে বাধ্য হন। মধ্যবর্তী কেউ একজন এ অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে না চাইলে তিনি সেখানে থাকতে পারবেন না, প্রথমত তাকে ভুল বোঝা হবে, তাকে অনিয়মের ভাগীদার না করলে পরে সে এ অনিয়ম ফাঁস করে দিতে পারে।  এমনকি পরবর্তী সময়ে এ অনিয়মের তদন্তকাজে অংশ নিয়ে অন্যদের ফাঁসিয়ে দিতে পারে এমনটি ভেবেই তাকে অনিয়মের পক্ষভুক্ত হতে বাধ্য করা হয়। ভাবখানা এই হয় সততা ও নৈতিকতাকে তালাক দিয়ে আমাদের সঙ্গে একাকার হয়ে যাও না হলে আলাদা পথ দেখো বাপু। এ ধরনের পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে দশের চক্রে ভগবানকে ভূত বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সমাজে ভালো বা নিরপেক্ষ লোকের জন্য দারুণ দুঃসংবাদ এটি। আমলা বলি আর সুশীল সমাজ বলি, বুদ্ধিজীবী বলি আর পেশাজীবী বলি সব ক্ষেত্রে এভাবে দলীয়করণ বা পক্ষভুক্তকরণের মহড়া চলতে থাকায় দল ও মত নিরপেক্ষদের বিড়ম্বনা বাড়তেই থাকে। এমন পরিবেশে দেখা যাবে আমলারা অধিকমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে পড়ছেন আর রাজনীতিতে নীতিনির্ধারকরা আমলার মতো আচরণে নিষ্ঠাবান হতে চলেছেন। অর্থাৎ যার যা করণীয় তা তিনি করছেন না, যার যা হওয়া উচিত নয় তিনি তাই-ই হচ্ছেন। কেউ স্বেছায় কেউবা বাধ্য হয়েই হচ্ছেন।  এ সবই একইভাবে দুর্নীতির নিয়ামক এবং দুর্নীতির প্রতিফলও বটে। এমতাবস্থায়  সমাজে বা পরিবেশে এখন দুর্নীতি এড়িয়ে চলায় ঝুঁকি বাড়ে এবং এর অনিবার্য  প্রতিক্রিয়া দেশ ও সমাজে বেশ হলাহলপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে থাকে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায় কারও কোনো কাজে বাড়তি খরচের এবং নিজেকে বাধ্যতামূলকভাবে দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলার পরিবেশ তৈরি হয়। এভাবে  সমাজের মধ্যকার সৃজিত বৈষম্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলীয়করণ, পক্ষভুক্তকরণের অস্বচ্ছ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতার বিড়ম্বনা বিপত্তি বাড়তেই থাকে। সভ্যতার সংকট শুরু হয় এভাবেই।  

দুর্নীতি ‘দমন’ কার্যক্রম মূলত দুর্নীতি হওয়ার পর তার কারণ অনুসন্ধান ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণের কার্যক্রমকে নির্দেশ করে। এটি পোস্টমর্টেম প্রকৃতির পদক্ষেপ। দুর্নীতি দমনে দুর্নীতির প্রতিরোধের পরোক্ষ প্রেরণা বা সুযোগ বাঞ্ছিত হলেও যথাসময়ে যথাযথ ‘দমন’ কার্যক্রমে অপারগতা বা বিলম্ব বা পক্ষপাতিত্বসুলভ ভিন্নতা দুর্নীতি এড়িয়ে চলার স্থলে অধিক হারে দুর্নীতি করার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। দুর্নীতি দমন সংস্থার নিজস্ব স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, দক্ষতা, প্রয়োগ কুশলতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে দুর্নীতি দমন দ্বিধান্বিত হতে পারে। দুর্নীতি হওয়ার পর শুধু নয় দুর্নীতির উৎসমূলে প্রতিরোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কীভাবে, কেন দুর্নীতি হচ্ছে কোন কোন অনুষঙ্গ এর জন্য দায়ী সেসব সমস্যাকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত প্রতিবিধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের বলিষ্ঠ বিকাশে এবং এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারককে সহায়তার ক্ষেত্রে সমাজ উন্নয়ন বীক্ষণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার ভূমিকা অগ্রগণ্য। বন্যা হলে পর বাঁধ দেওয়ার কথা ভাববার চেয়ে বন্যার উৎস অনুসন্ধান এবং সেখানকার শুদ্ধিকরণ অগ্রাধিকারে আসা উচিত। সুতরাং দমনের চেয়ে নিয়ন্ত্রণে, নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রতিরোধে, প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিষোধনে বিশেষ মনোযোগ ও বিবেচনায় আনা আবশ্যক হবে দুর্নীতি প্রশমন প্রয়াসে।

সবার স্বার্থেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সবারই সচেষ্ট হওয়া উচিত। দুর্নীতির করালগ্রাসে অর্থনীতি, সমাজ, সংসার দেশ সব জায়গা কলুষিত হতে পারে, দেশ ও চরিত্রের সুনাম নষ্ট হলে তার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া সবাইকে ভোগ করতে হয়। সুতরাং নিজে ‘ভালো’ থাকলেই যথেষ্ট নয় অন্যেরা মন্দ হলে নিজের ভালোত্ব টিকে থাকবে কতক্ষণ।

‘জনসেবার’ নামে  যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসতে (তা ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব হোক কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ হোক) অবৈধভাবে অর্থ বিনিয়োগের প্রথায় দুর্নীতি ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিলাভ করে নির্বাচিত হওয়ার জন্য  অধিকমাত্রায় যদি অর্থ বিনিয়োগ হয় ক্ষমতায় গিয়ে মহাদুর্নীতির মাধ্যমে সেই অর্থ উদ্ধারের প্রয়াস চলাটাই স্বাভাবিক। আবার এমনকি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর এই দুর্নীতির ‘দমন’ কার্যক্রম মোকাবিলার পাথেয় বা অবলম্বন হিসেবেও দুর্নীতির মাধ্যমে আগাম অর্থ উপার্জনের বায়না ধরা হতে পারে। এমতাবস্থায় সমাজে এ ধারণাও পরিব্যাপ্ত হতে পারে যে দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার পর মামলা বা জেলজুলুমে টিকে থাকার জন্য তো আজ কিছু উপার্জন করে রাখা দরকার। মহাদুর্নীতির  যৌক্তিকতা এভাবে হালে পানি পেতে পারে। নেতৃত্বের পালাবদলে দুর্নীতির অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে এমন অবস্থার প্রতিফলন ঘটাও বিচিত্র নয় যখন বলা হয় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই’  প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং সেখানে এমন ফাঁকফোকর থেকে যায় বা রাখা হয় যা পরে এটিকে প্রতিহিংসার প্রতিফল বলে খারিজ হয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে থাকে। এটি পর্যায়ক্রমে পক্ষে-বিপক্ষের বেলাতেও ঘটতে পারে এবং এভাবে প্রকৃত দুর্নীতি বারবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারে। এসব দেখে, জেনে ও শুনে দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের ওপর একদিকে যেমন ভোটার তথা আমজনতার মধ্যে সৃজিত হতাশা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতি নেতিবাচক মনোভাবে পরিব্যাপ্ত হয়, অপরদিকে পেশাদার দুর্নীতিবাজ নিজেদের অধিকতর নিরাপদ ও অভয়াশ্রমের অধিবাসী হিসেবে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে। জনগণের জানমাল, সম্পদ-স্বার্থ ঠিকই লুণ্ঠিত হচ্ছে কিন্তু দোষ আর দোষীর প্রতিবিধান বিদ্যমান ব্যবস্থায় আর হয়ে ওঠে না।

দুর্নীতির দ্বারা অজিত অর্থ দুর্নীতির দমন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার কাজে ব্যবহৃত হওয়াও ক্ষেত্রবিশেষে অস্বাভাবিক নয়। খোদ বিধায়করাই যখন অন্যায়-অনিয়মে তথা অনৈতিকতায় আইনেরই আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভ করেন তখন ভোটারদের আস্থাহীনতায় নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, তাদের হতাশার সীমা-পরিসীমা থাকে না। দেখা যায় নিজের সম্পর্কে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কিংবা বিতর্কিত পন্থায় নির্বাচিত  হলেও  তার প্রতিকার প্রতিবিধানের কোনো ব্যবস্থা বিদ্যমান নেই। প্রতিকার প্রার্থনায় এক কর্তৃপক্ষ ‘এটি আমাদের এখতিয়ার নয়, অমুক তার নিজস্ব নিয়মে বিষয়টির ওপর ব্যবস্থা নিতে পারে’, অমুক ‘আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো নির্দেশনা নেই, ভবিষ্যতে দেখা যাবে’ ইত্যাদি বলে পাশ কাটিয়ে ওয়াকওভার দেওয়ায় এসব বিতর্কিত নির্বাচনের মতো মহাদুর্নীতির কোনো প্রতিবিধান আর হয় না। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো প্রতিকার প্রার্থনার অভিযোগটির নিষ্পত্তি বিতর্কিত ব্যক্তির সদস্যপদের মেয়াদকাল পার হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে একজন ভোটার যখন দেখে একজন অবৈধ দুর্নীতিবাজকে নির্বাচনের কৈফিয়ত তাদের বিবেকের কাছে দিতে হচ্ছে, অন্যায়ের প্রতিবিধান কর্মের নিষ্পত্তি নেই এবং দুর্নীতিই বহাল তবিয়তে থাকছে। এটা  নির্বাচকম-লীর নৈতিক মূল্যবোধের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে আর যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান ব্যবস্থার প্রতি আস্থার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি করে থাকে। এ অবস্থা সমাজের সর্বস্তরে ক্ষৈত্রিক পর্যায়ে দুর্নীতি বিস্তার রোধের ক্ষেত্রে শুধু নেতিবাচক আবহই তৈরি করে। 

দুর্নীতি হয় আইনকানুন, বিধিবিধান, পদ্ধতি প্রক্রিয়া, রীতিনীতি উপেক্ষা বা লঙ্ঘনের সুবাদে। আইনকানুন অনুসরণ ও অপারগতায় একে এড়িয়ে চলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আইনকানুন অনুসরণ অপারগতার কারণ অনুসন্ধানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে আইনকানুন পদ্ধতি প্রক্রিয়া যুগোপযোগী নয়। বস্তুত মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও চাহিদার পরিবর্তনশীলতার গতি আর বিদ্যমান আইনের এখতিয়ার নির্ধারণের, প্রয়োগ কৌশলের গতিমাত্রার সঙ্গে অগ্রগামী বা নিদেনপক্ষে সমান্তরাল না হলে আইনকানুন অনুসরণে অপারগতা, উপেক্ষার পথ প্রদর্শিত হবেই। বাংলাদেশে প্রচলিত অধিকাংশ আইনকানুন বিধিবিধান জন্মগতভাবে বেশ বর্ষীয়ান (ব্রিটিশ কিংবা সাবেক পাকিস্তান আমলের), দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক এবং এ সবের প্রয়োগ প্রক্রিয়াও বেশ  জটিল। এর ভাষা ও ব্যাখ্যায় ব্যাপক দ্ব্যর্থবোধকতা বিদ্যমান, এসব আইনের দৃষ্টিভঙ্গিও সর্বজনবোধ্য ও গ্রহণযোগ্যতা রহিত। প্রচলিত আইনকানুন পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় যুগোপযোগী সংস্কার সাধনের  মাধ্যমে আইনকানুনের উপেক্ষাজনিত দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রশমন সম্ভব ও সহজতর হতে পারে। এদেশের আবহাওয়া, মনোভাব মনোভঙ্গির, আচার অনুষ্ঠান অনুযায়ী আইন এবং সেই আইনের ভাষ্য এদেশের দেশ, সমাজ ও সংসারে ডাইজেস্টবল হলেই আইন অমান্যের, লঙ্ঘনের, উপেক্ষার সমস্যা সংকুচিত হবে।

যতদূর সম্ভব জটিলতা পরিহারপূর্বক পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ করার আবশ্যকতা অনুভূত হলেই শুধু চলবে না বাস্তবতার নিরিখেই এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সহজতর হতে পারে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবার প্রতি সমান সুযোগ নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। একই অপরাধ একেক সময় ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিতে প্রত্যাহার কিংবা প্রয়োগ প্রকারান্তরে যে সংক্ষুব্ধতা ও অসহায়ত্বের আবহ তৈরি হয় তাতে  দুর্নীতি প্রশমন প্রতিরোধ ও দমন কার্যক্রমের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পায়। এর প্রতিফল অত্যন্ত হতাশাজনক পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ নিরসনে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়চিত্ততা ও অয়োময় অবস্থান গ্রহণ, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য প্রদানের প্রয়াস প্রচেষ্টা বিশ্বাস ও বাস্তবায়নে চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হতে হবে। মাথা থেকে শুরু হলে কোনো কর্মসূচিই মাছের পচনকে ঠেকাতে সক্ষম হয় না। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ওপর থেকে অন্যের জন্য যে বাণী বা বারতা নির্দেশ করবে সব অধস্তন তাতে পেয়ে যাবে নির্দেশনা। এখানে আপসকামিতা ও পক্ষপাতিত্বের কোনো অবকাশ থাকতে নেই।

দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এই মূল্যবোধের বিকাশ যখন সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে তখন দুর্নীতি দমন নিয়ন্ত্রণ প্রশমন প্রতিরোধ সবই সহজতর হতে বাধ্য। ভালো কাজের স্বীকৃতি বা পুরস্কার আর মন্দকাজের নিন্দা বা তিরস্কারে  স্থির প্রাজ্ঞ থাকা দরকার। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে  বেতন বা মজুরি কাঠামো পুনর্বিন্যাস আবশ্যক হবে, স্বল্প ও সীমিত বেতনভুকদের নৈতিকতার পথে থাকতে সুরক্ষা দিতে হবে নতুবা মূল্যবোধ বজায় রাখা কঠিন হতে পারে। মাথাভারী প্রশাসনকে যথাযথভাবে সুষম সমন্বয়করণের মাধ্যমে লোকবল কমিয়ে এনে ভালো বেতন দিয়ে উৎপাদনমুখী কর্মতৎপরতায় গুণগত উৎকর্ষতা সাধনে সচেষ্ট হওয়া যেতে পারে।

লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যান

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত