গত ১২ মে মাঠে গরু চরাতে গিয়েছিলেন হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার স্বজনগ্রামের ৭০ বছরের আজগর আলী। কিন্তু প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেননি। আকস্মিক বজ্রপাতে মাঠেই প্রাণ হারান আজগর আলী। এর আগের দিন আজমিরিগঞ্জের ডেমিকান্দি গ্রামের যুবক সাজু মিয়া বাড়ির পাশে একটি খালে গোসল করতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান। এভাবে প্রতিবছর হবিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন নানা বয়সী নর-নারী। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ধান কাটার রঙিন স্বপ্ন নিয়ে হাওরে যাওয়া কৃষকরা বজ্রপাতের আতঙ্কে ভুগছেন। প্রতি বছরই জেলার কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। হতভাগ্যদের বেশির ভাগই হাওরে ধান কাটতে যাওয়া কৃষক বা শ্রমিক।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে গত ৫ বছরে হবিগঞ্জ জেলায় ৮১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এরমধ্যে ৫৫ জনই কৃষক। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর ৬৮ শতাংশই কৃষক। চলতি বছরের ১২ মে পর্যন্ত জেলায় আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বজ্রপাত থেকে জানমাল রক্ষায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পে ১৫টি জেলায় ৩৩৫টি লাইটনিং এরেস্টার (বজ্রনিরোধক যন্ত্র) বসানো হয়। এতে ব্যয় হয় ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পের আওতায় হবিগঞ্জ জেলায় ৩৩টি এরেস্টার স্থাপনে খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। এরমধ্যে বাহুবল উপজেলায় দুটি, নবীগঞ্জে ছয়টি, বানিয়াচঙ্গে ৭টি, আজমিরিগঞ্জে ছয়টি, হবিগঞ্জ সদর তিনটি, লাখাই তিনটি, শায়েস্তাগঞ্জে দুটি, চুনারুঘাটে দুটি ও মাধবপুর দুটি রয়েছে।
বানিয়াচং উপজেলায় খোঁজ দেখা যায়, একটি বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হয়েছে হবিগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মজিদ খানের ব্যক্তিগত পুকুরপাড়ে। তা ছাড়া বানিয়াচঙ্গ উপজেলা প্রশাসনের ভবন এবং ইকরাম পুলিশ ফাঁড়িতে আরও দুটি যন্ত্র বসানো হয়েছে। বাকিগুলো বসানো হয়েছে কৃষকের উপস্থিতি কম বা চাষাবাদ হয় না এমন সব জায়গায়। অথচ বজ্রপাতের প্রধান শিকার হচ্ছেন ফসলের মাঠে কাজে থাকা কৃষক।
কবিরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বজ্রপাতনিরোধ যন্ত্র হাওরে না বসিয়ে সাবেক এমপির পুকুরপাড়ে বসানো হয়েছে। প্রশাসন এমপি সাহেবের পরিবারের কথা ভেবেছে, কিন্তু আমাদের জীবনের মূল্য বুঝেনি।’
তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি যন্ত্র চারপাশের ১০৮ মিটার এলাকায় বজ্রপাত নিরোধ ও তথ্য সংরক্ষণ করবে। কোটি কোটি টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও মাঠে এর কার্যকারিতা আছে কি না তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানা নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এ পর্যন্ত যন্ত্রগুলো কতটি বজ্রপাত ঠেকাতে পেরেছে সে তথ্যও নেই সংশ্লিষ্ট অফিসে।
তবে দেশ রূপান্তরের হাতে আসা এক তথ্যে দেখা যায়, বানিয়াচঙ্গের ৪টি বজ্রনিরোধক যন্ত্র গত তিন বছরে কোনো বজ্রপাতই নিরোধ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাদের রহমান বলেন, ‘এরেস্টারগুলো সচল কি-না বা ঠিকভাবে কাজ করছে কি-না, তা আমাদের জানা নেই।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফরিদুর রহমান বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে প্রাণ রক্ষা করতে হলে শুধু এরেস্টার বসিয়ে হবে না। এর সঙ্গে দরকার সচেতনতা বাড়ানো। হাওরপাড়ে বজ্রনিরোধক যন্ত্রসহ বজ্রপাত সহনশীল আশ্রয়কেন্দ্র যেন নির্মাণ করা হয়, সে ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছি।’