শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ফারাক্কা লংমার্চ এবং ভাসানী

আপডেট : ১৭ মে ২০২৫, ০৩:১৯ এএম

১৬ মে ১৯৭৬। মওলানা ভাসানী ডাক দিয়েছিলেন ফারাক্কা লংমার্চের। সেই কথা কি মনে রেখেছে দেশের শাসকরা? নদীর দেশ পানির দেশ আর পলির দেশ বাংলাদেশ। এদেশ বন্যায় প্লাবিত হয়, পলি এসে সতেজ করে আবাদি জমি, পানির ধাক্কায় নদীর পাড় ভাঙে, বিলীন হয় ঘরবাড়ি, গ্রামগঞ্জ; আবার জেগে ওঠে নতুন চর। অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বলে, নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। এ-রকম কথা ইউরোপের দানিয়ুবের পাড়ের মানুষ বলবে না বা বুঝতেও চাইবে না। কারণ ইউরোপের নদীতে পানি উপচে পড়ে কিন্তু মাইলের পর মাইল পাড় ভাঙে না। নদী দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশকে বলা হয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদী দিয়ে গড়া এই বাংলাদেশ এখন নদীর মৃত্যু দেখছে। নদী প্রাকৃতিক কারণে তার গতিপথ পরিবর্তন করে, নদী খাত পালটে যাওয়ায় পুরনো খাতে পানির প্রবাহ আগের মতো থাকে না। মানুষ বসতি ও ফসল রক্ষার নামে বাঁধ দেয়, উন্নয়নের নামে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয় এবং যার কুফল ভোগ করতে হয় মানুষকেই। কিন্তু যখন রাজনৈতিক কারণে বা রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বিস্তারের জন্য পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় তখন তার পরিণতি হয় ভয়াবহ এবং এর প্রভাব পড়ে দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশের উজানের দেশ ভারতের ভূমিকা এ-রকমই।

নদী এবং পানি আগ্রাসন যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সতর্ক করেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তার সেই প্রয়াসের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো, ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ। ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ১৯৬১ সালে নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৭৫ সালে চালু করা হয়। ফারাক্কা বাঁধের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা, যাতে কলকাতা বন্দরের কার্যকারিতা বজায় থাকে। ভারত তার নিজের দেশের বন্দরের কথাই ভেবেছে, ভাবেনি এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহ, কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ওপর কী ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাঁধটি প্রায় ২২৪০ মিটার (৭৩৫০ ফুট) দীর্ঘ এবং এর গেটের সংখ্যা ১০৯। ফারাক্কা বাঁধ শুধু গঙ্গার পানি আটকানো নয়, ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের সংযোগ রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

১৯৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী বলেন, অভিন্ন নদীর পানি কোনো দেশ এককভাবে ব্যবহার ও  নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করতে, ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ রুদ্ধ করতে চায়। তিনি তার বক্তব্যে সরকারের প্রতি বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনের আহ্বান জানান। ২০ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা সময় মতো পানি না পেলে আমাদের কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সেচ বন্ধ হয়ে যাবে। এদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনমরণ সমস্যা হচ্ছে। ভারতের অবস্থান আমাদের উজানে হওয়ায় তারা এ সুযোগ গ্রহণ করেছে। ভারত একতরফাভাবে কোনো আন্তর্জাতিক নদী নিয়ন্ত্রণ করে, শুষ্ক মৌসুমে পানি নিয়ন্ত্রণপূর্বক বাংলাদেশকে চরম ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। পানি ছেড়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যায় দেশ ভাসিয়ে দিতে পারে বর্ষাকালে। বলেছিলেন, ভারত শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সংগতভাবে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করুক এটাই আমরা চাই। না হলে ভারতের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করা হবে।মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দেন, তখন তার বয়স ৯৬ বছরের বেশি। বয়স এবং অসুস্থতা তাকে থামাতে পারেনি। ফারাক্কায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীকে অবমুক্ত করার সুমহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই  ‘ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ’-এর ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির ওপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শাশ্বত অধিকার যে হরণ করেছে, তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।’

লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৬ সালের ২ মে মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়। এর পরে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করে কমিটির সংখ্যা ৭২ জনে উন্নীত করা হয়। এই লংমার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লিখে আব্দুল হামিদ খান ভাসানী লংমার্চের কারণ বর্ণনা করেছিলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীর প্রেরিত পত্রের জবাবে লিখেছিলেন- ‘এটি ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি বর্তমানে আমাদের এত বেশি ভুল বুঝেছেন, এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।’ ইন্দিরা গান্ধীর পত্রপ্রাপ্তির পর মওলানা ভাসানী আবারও ইন্দিরা গান্ধীকে লিখেছিলেন, ‘আপনার ৪ মে’র পত্র ফারাক্কার ওপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপূরুষ মতিলাল নেহরুর দৌহিত্রী ও পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যার কাছ থেকে আমার এরূপ প্রত্যাশা ছিল না। ফারাক্কা সম্পর্কে আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সফর করে আমাদের কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তা নিরূপণ করার জন্য। আমি আপনাকে সরকারি কর্মকর্তাদের রিপোর্টের ওপর আস্থা স্থাপন না করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ এগুলো প্রায়ই বিদ্যমান অবস্থার প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন নয়। পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানে আপনার পথকে আমি প্রশংসা করি। তবে সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দু’মাসের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বরং বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বণ্টন ভিত্তিক হওয়া উচিত।’

৫০ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে মওলানা ভাসানী যা অনুমান করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে সেটিই ঘটেছে। বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভাসানীর চিঠির উত্তর দিলেও, ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফলে মওলানা ভাসানী সীমান্ত পেরিয়ে ফারাক্কা অভিমুখী লংমার্চ কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এই ঘটনায় ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে। ফলে সীমান্তে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার মওলানাকে সীমান্ত অতিক্রম না করে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরই লংমার্চ সমাপ্ত করার আহ্বান জানায়। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভাসানী সীমান্তের খুব কাছে সমাবেশ করে লংমার্চ শেষ করেন। সীমান্তে ভারতের সৈন্য সমাবেশের তীব্র নিন্দা করে মওলানা ভাসানী বলেন, আমরা শান্তি চাই। আর ওরা যুদ্ধ চায়। বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনতার ভয়ে তারা সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে। আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি। তিনি আরও বলেন, আমাদের এই মিছিল বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রামের প্রতীক। ভাসানীর এই প্রতীকী প্রতিবাদ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। ভাসানীর এই লংমার্চ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাড়া ফেলে। আর দেশের ভেতরে পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়। মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চের ফলে ১৯৭৭ সালে প্রথম ফারাক্কা চুক্তিতে পানির যে ভাগাভাগি হয়, তাতে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরবারাহের গ্যারান্টি ক্লজ সংযুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় চুক্তিতে গঙ্গা নদীর শীতকালীন গড় প্রবাহের অর্ধেক পানি সরিয়ে কলকাতা অভিমুখে প্রবাহিত  করার অধিকার দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে চুক্তি থেকে গ্যারান্টি ক্লজ তুলে দেওয়া হয়। ফলে এই চুক্তিটি চরম বৈষম্যমূলক এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থী। তারপরও চুক্তি অনুযায়ী, খরা মৌসুমের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশেকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা। কিন্তু গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় ভারত চুক্তি অনুযায়ী পানি দেয়নি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পানি মিলেছে মাত্র তিন বছর। ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। উত্তরাঞ্চলে মরূকরণ, জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়।

শুধু গঙ্গা নয় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির হিস্যা নিয়েও ছলচাতুরী করছে ভারত। তিস্তার উজানে গজলডাঙ্গাসহ তিনটি বাঁধ দিয়ে নিয়মিত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। একদিকে শুকনো মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে বিপদে ফেলছে আর অন্যদিকে, বর্ষা মৌসুমে বাঁধ খুলে দিয়ে বানের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। পানিকে অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করছে ভারত। সর্বশেষ ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ভারত ত্রিপুরার ডাম্বুর জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধ খুলে দিলে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের ৫টি জেলা বন্যায় ভেসে যায়। এ-রকম বন্যা এ অঞ্চলের মানুষ কখনো দেখেনি। এছাড়াও রয়েছে সুরমা কুশিয়ারার উৎস বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের হুমকি। হুমকি রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নিয়েও। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্র নদ ভারতের আগ্রাধিকার প্রকল্প। এটা করা হলে, বাংলাদেশে বিশাল পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। উজানের পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলে নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানির প্রবাহ কমতে থাকলে সমুদ্রের লবণাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ, মধুমতির কামারখালী, ধলেশ্বরীর মানিকগঞ্জ ও মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে। সমগ্র যমুনা নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এই সর্বনাশের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে এখন দেশের মানুষ। এখন দরকার রুখে দাঁড়ানোর আহবান। নদী ও পানির উপর ভারতের আগ্রাসন এবং দেশের অভ্যন্তরে নদী দখল ও দূষণ রোধের আন্দোলনে ভাসানীর শিক্ষা আজ বড় প্রয়োজন।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত