বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

শুভাঢ্যা খালে জল আনতে কোটি কোটি টাকা জলে... 

  •  দখল দূষণে বিলীন শুভাঢ্যা খাল
  •  হেঁটেই পার হওয়া যায়
  • খাল রক্ষায় এবার ৩১৭ কোটি টাকার 
    প্রকল্প অন্তর্বর্তী সরকারের 
আপডেট : ১৭ মে ২০২৫, ০১:০৮ এএম

‘এক সময় শুভাঢ্যা খালে রোজ গোসল করতাম। কিন্তু সেই দিন আর  নেই। খালের পানি পচে কালো হতে হতে খালটাই মরে গেল। মানুষ এখন এপার থেকে ওপার হেঁটেই যেতে পারে। বেশ কয়েকবার খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খালি টাকা খাওয়ার ধান্দা।’ 

কেরানীগঞ্জে শুভাঢ্যা খালপাড়ের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা তৈয়ব আলী। আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন এসব কথা। শুধু তিনিই নন; খালের দুই পাশের সব বাসিন্দার আক্ষেপ একই। তারা খালটির অতীতের সঙ্গে বর্তমান অবস্থা তুলনা করতে গিয়ে এখন বিস্মিত। বলছেন খালটি রক্ষায় বিগত দিনে কোটি কোটি টাকা হয়েছে নয়ছয়। 

বুড়িগঙ্গা দিয়ে শুরু হয়ে কালিগঞ্জ জিলা পরিষদ মার্কেট হয়ে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ শুভাঢ্যা খালটি রাজেন্দ্রপুর বাজার এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে। দখল দূষণে খালটির বর্তমান অবস্থা করুণ। দেখে বোঝার উপায় নেই এই খাল দিয়েই এক সময় বড় বড় নৌকা চলত। 

শুভাঢ্যা খাল রক্ষায় ইতিপূর্বে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার উদ্যোগ। কিন্তু কোনো কাজই দৃশ্যমান হয়নি। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে খাল খননের কাজ শুরু করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই সময় খালের দুই পাড়ে বøক বসিয়ে তীর সংরক্ষণ ও পুনঃখননের কাজ হয়। ২০১৬ সালে কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে খালের বর্জ্য অপসারণ করা হয় ।

স্থানীয়রা বলছেন প্রত্যেকটি প্রকল্পই ছিল লোক দেখানো, কাজ করে অর্থ আত্মসাৎ করা। খালের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। খালরক্ষায় সরকারের পক্ষ  থেকে বরাদ্দ আসলেও সেই বরাদ্দ খাতাপত্রের মধ্যই সীমাবদ্ধ থাকত। কিছু কাজ করার পর বন্ধ করে দেওয়া হতো বাকি কাজ।

যে সুফল পাবে এলাকাবাসী

স্থানীয়রা জানান, শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধার করা হলে এর সুফল ভোগ করবে এলকাবাসী। খাল পরিষ্কার করলে আশপাশের পরিবেশ আরও সুন্দর হবে এবং স্বাস্থ্যকরও হবে।
সেলিম নামের খালপাড়ের এক বাসিন্দা জানান, ‘খালটি এখন ময়লার ভাগাড়, ময়লার দুর্গন্ধে আমরা বাসায় থাকতে পারি না। বাচ্চাদেরও নানা অসুখ হয়। খালটি পরিষ্কার করা হলে আমরা এ ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাব। মশা-মাছির উপদ্রবও কমবে বা বন্ধ হবে। 

ওই এলাকারই সেন্টু মিয়া জানান, ‘খালটি পরিষ্কার করে দুই তীরে ওয়াকওয়ে তৈরি করলে বাচ্চাদের খেলার জায়গা হবে। এখন ময়লার কারণে খালের পাড়ে কেউ দাঁড়াতে পারে না। খালটি পরিষ্কার করলে স্থানীয়দের বিনোদনের জায়গাও তৈরি হবে। খালের আশপাশে বসবাসকারী মানুষের জীবনমান উন্নত হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘ময়লার ভাগাড় হওয়ার কারণে এদিক দিয়ে মানুষের যাতায়াত কম; মাদকসেবনকারীদের আখড়া হয়ে গেছে কিছু কিছু জায়গা। খালের ময়লা পরিষ্কার করা হলে এখান দিয়ে মানুষের যাতায়াত বাড়বে ও মাদকসেবীদের আড্ডা কমবে।’ 

অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি খালটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, শুভাঢ্যা খাল পুনঃখনন প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজ করবে। প্রায় ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের আওতায় খাল খননের পাশাপাশি পাড় বাঁধাই, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজও সম্পন্ন করা হবে।
 
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ময়লা পরিষ্কার করলেই হবে না, খালের অনেক স্থানে পুনঃখননের প্রয়োজন রয়েছে। আগামী অর্থবছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।’ খাল যাতে পুনরায় বর্জ্য ফেলে ভরাট না হয়, সেজন্য স্থানীয়দের সচেতন থাকার আহŸান জানান তিনি।

তবে স্থানীয়রা বলছেন শুভাঢ্যা খাল নিয়ে এর আগে অনেকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। এবার অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিচ্ছে তাতে তারা আশাবাদী। তাদের দাবি খাল রক্ষায় আর যেন নয়ছয় না হয়। শুভাঢ্যা যেন ফিরে পায় তার হারানো জীবন। 

স্থানীয়রা জানান, এই খালটিই এক সময় বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সংযোগ স্থল ছিল। খালে আগে প্রতিবছর নিয়ম করে নৌকাবাইচ হতো, নৌকা চলত, খালে স্থানীয়রা মাছ ধরত, আশপাশের প্রয়োজনীয় অনেক কাজই করত খালের পানি দিয়ে। এখন খালের  বেশির ভাগ জায়গায় দখলে চলে গেছে। খালের যতটুকু দেখা যায়,  সেটুকু বর্জ্যও পলিথিনে ভরা। ময়লা দিয়ে ভরাট করতে করতে খালটির কিছু জায়গায় এই পাড় থেকে ওই পাড়ে  হেঁটেই পার হয়  লোকজন।
খালটির জিলাপরিষদ মার্কেট থেকে কালিগঞ্জ বাজার পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, গার্মেন্টসপল্লীর কারখানাগুলোর ঝুট, পলিথিন,পরিত্যক্ত কাপড়সহ সব ধরনের ময়লা ফেলে খালটিকে ভরে ফেলা হয়েছে।  দেখে মনে হচ্ছে এটি ময়লার ভাগাড়। 

আমবাগিচা, বেগুনবাড়ি, গোলামবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুই পাড়ের বাসিন্দারা ইট সুরকি, ময়লা, রাবিশ দিয়ে একটু একটু করে খালটি ভরাট করে দখল করছে প্রতিনিয়ত। কালিগঞ্জ বাজারের অংশে খালের দুই পাড়ের ওপর স্থানীয় নেতারা তৈরি করেছে কয়েকশ অবৈধ দোকান। এসব দোকানের ময়লা সবই ফেলা হচ্ছে খালে। চিতাখোলা এলাকায় শুভাঢ্যা খালের অংশে মাটি ভরে ঘাস জন্মেছে। কোথাও কোথাও খালের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় ভবন। 

কালিগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লীর ব্যবসায়ী আব্দুল আলীম বলেন, যখন খালে পানি ছিল তখন কেউ ময়লা ফেলার আগে ভাবত। আর এখন তো যে যেমনি পারে ময়লা ফেলে। খালটি পরিপূর্ণ পরিষ্কার করে পানি ফিরিয়ে আনলে ময়লা ফেলা হয়তো কমবে।
আমবাগিচা এলাকার বাসিন্দা রহিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, খালের তীর ঘেঁষে যাদের বাড়ি, তারা একটু একটু করে ময়লা ফেলে দখল করছে, দুই পাড়ের বাসিন্দারা ডাস্টবিনে ময়লা না ফেলে খালেই ময়লা ফেলছে। উপজেলা প্রশাসন কঠোরভাবে এ বিষয়ে নজরদারি করলে ময়লা ফেলা বন্ধ হবে। 

 বেগুনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মুসা বলেন, একদিকে ময়লা অন্যদিকে অবৈধ দখলদার দুই মিলে খালটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং উপজেলা প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকায় খালটার এ অবস্থা। সরকারের কাছে আমরা আহŸান জানাই, খালটি পরিষ্কার কওে যেন পরবর্তী সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

কালিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রবিন বলেন, আগে আওয়ামী লীগ নেতারা খাল দখল করে ভাড়া দিত। এখনো থেমে নেই, আরেকটা দল ক্ষমতায় না আসতেই খাল দখল করে অবৈধ দোকান উঠাচ্ছে। সরকারের উচিত আগে দখলদারদের দখল থেকে খাল রক্ষা করা।

খাল রক্ষায় কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সমিতির কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না এবং এখানকার কারখানার ময়লাগুলো সরাসরি খালে ফেলা থেকে বিরত রাখতে তারা কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না- এ বিষয়ে জানতে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও  দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হাজি আনোয়ারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। 

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জান্নাতুল মাওয়া বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার সময় উপজেলা প্রশাসন  থেকে খালের দখল হওয়া অংশ ফেরত আনতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত