মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

শুভ জন্মদিন স্যার কোনান ডয়েল

আপডেট : ২১ মে ২০২৫, ০৩:৩১ এএম

স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, শার্লক হোমসের রচয়িতার জন্মদিন আগামীকাল ২২ মে। তার অনন্য জীবন ও শার্লক হোমস নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

আহ্, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল! এই নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুদ্ধিদীপ্ত শার্লক হোমসের ছবি, পাইপ হাতে ধোঁয়া ছেড়ে জটিল রহস্যের জট ছাড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই মানুষটির নিজের জীবনই কোনো কম রোমাঞ্চকর উপন্যাসের চেয়ে কম ছিল না? চলুন, আজ আমরা এই বহু-প্রতিভাধর মানুষটির জীবনের কিছু মজার অধ্যায় তুলে ধরি।

তিনি ছিলেন একাধারে ডাক্তার, উকিল, রাজনীতিক, এমনকি এক সময়ের পেশাদার ক্রিকেটারও!

ডয়েলের জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিস্ময়। ডাক্তারি পড়েছেন এডিনবরায়, সেখানেই শিখেছেন জীবনের সূক্ষ্মতা বোঝার চোখ। চিকিৎসা পেশা ছাড়াও, কোর্টে দাঁড়িয়ে যুক্তি দিয়ে লড়েছেন আইনের জটিল লড়াই। রাজনীতির ময়দানে নেমে সমাজে ন্যায়ের বার্তা ছড়াতে চেয়েছেন। আর এসবের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ব্যাট ধরেছেন মাঠে ক্রিকেট মাঠে। মজার কথা, সেই ব্যাটিং ছিল অনেকটা বাটলারের মতো, ছন্দময় অথচ অননুমেয়!

বলও করেছেন, যদিও সেটা জোরে নয়। তবুও যদি কোনো ম্যাচে ৭ উইকেট নিতে পারেন, তাহলে বলের গতি দিয়ে নয়, কৌশল দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন তার ক্ষমতা। এখানেই ডয়েল আলাদা। তিনি প্রতিভার বাইনারি ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন চর্চা আর মেধার সুষম মেলবন্ধনে।

রহস্যের জন্মদাতা

ডয়েলের জন্ম ১৮৫৯ সালে। ডাক্তারির পড়াশোনা শেষ করে পেশা হিসেবে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ভাবুন তো, ভবিষ্যতের বিশ্ববিখ্যাত লেখক, যার কলম থেকে বেরোবে শার্লক হোমসের মতো কালজয়ী চরিত্র, তিনি কি না তিমি শিকারি জাহাজে ডাক্তার হিসেবে কাজ করছেন? হ্যাঁ, ১৮৮০ সালে তিনি গ্রিনল্যান্ডের তিমি শিকারি জাহাজ ‘হোপ’-এ সার্জন হিসেবে চড়ে বসেছিলেন! এরপর এসএস মায়ুম্বা জাহাজেও ওয়েস্ট আফ্রিকান উপকূলে তার ডাক্তারি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভাবুন, এসব কঠিন আর বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাই হয়তো তার লেখনিতে গভীরতা এনেছিল।

শার্লক হোমস

১৮৮৭ সালে ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসে শার্লক হোমসের আগমন ঘটল। পাঠক তো হোমস পড়ে মুগ্ধ, রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার গল্পের ওপর! কিন্তু ডয়েলের কি হলো জানেন? নিজেরই সৃষ্ট চরিত্র তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াল! হোমস এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন যে, ডয়েল চাইলেও আর অন্য কিছু লিখতে পারছিলেন না।

তার অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাস বা কল্পবিজ্ঞান গল্প, যা লিখতে তিনি ভালোবাসতেন, সেগুলোর প্রতি পাঠকের তেমন আগ্রহই ছিল না। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ডয়েল সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘আর না! হোমসকে মেরে ফেলি!’ ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে তিনি হোমসকে প্রফেসর মরিয়ার্টির সঙ্গে রাইখেনবাখ জলপ্রপাতে ফেলে দিয়ে ‘খুন’ করে দিলেন। কিন্তু পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখে ডয়েল নিজেই চমকে গেলেন! প্রতিবাদের ঝড় উঠল, মানুষ শোক পালন করতে লাগল, এমনকি নাকি রানী ভিক্টোরিয়াও শোকাহত হয়েছিলেন। শেষে বাধ্য হয়েই ডয়েল হোমসকে আবার ফিরিয়ে আনলেন! এ যেন নিজের সন্তানকে হত্যা করে আবার পুনরুজ্জীবিত করার মতো এক মজার ঘটনা! হোমস চরিত্রটি আংশিকভাবে তৈরি হয়েছিল তার প্রাক্তন শিক্ষক ড. জোসেফ বেলের আদলে। বেল নাকি রোগীকে না দেখেই তার রোগ সম্পর্কে বলে দিতে পারতেন, শুধু তাদের চালচলন আর কথা বলার ধরন দেখে। এ থেকেই ডয়েল হোমসের সেই বিখ্যাত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পেয়েছিলেন!

কলম ছেড়ে খেলার মাঠে

ডয়েল শুধু কলমবাজ ছিলেন না, তিনি ছিলেন রীতিমতো একজন ক্রীড়াবিদ!

গোলকিপার ডয়েল : বিশ্বাস করবেন না, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল একজন ফুটবলারও ছিলেন! তিনি ‘এ. সি. স্মিথ’ ছদ্মনামে পোর্টসমাউথ অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল ক্লাবের গোলকিপার হিসেবে খেলেছেন। কল্পনা করুন, একজন বিখ্যাত লেখকের নাম বদলে ছদ্মনামে গোলপোস্টে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিপক্ষের শট ঠেকানোর জন্য! ব্যাপারটা বেশ মজার, তাই না?

ক্রিকেটপ্রেমী : তিনি একজন উৎসাহী ক্রিকেটার ছিলেন এবং ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে বিখ্যাত মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাবের (গঈঈ) হয়ে খেলেছেন। তার মানে শুধু মাথায় বুদ্ধি নয়, মাঠেও তার হাত চলত!

রহস্যময় ডয়েল

ডয়েলের জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং বিতর্কের জন্ম দেওয়া দিকটি হলো তার প্রেতাত্মাবাদে বিশ্বাস। জীবনের শেষদিকে তিনি প্রেতাত্মা এবং পরকালে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু বিশ্বাসই করতেন না, জনসম্মুখে এর প্রচারও করতেন! এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার আপনজনদের হারানোর পর এই বিশ্বাস আরও পোক্ত হয়। মানুষ তখন বলাবলি করত, ‘শার্লক হোমসের মতো বুদ্ধিমান চরিত্র যিনি তৈরি করেছেন, তিনি কি না প্রেতাত্মা নিয়ে ব্যস্ত!’ এই দিকটি তার জীবনকে আরও রহস্যময় এবং কৌতূহলপূর্ণ করে তোলে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল একজন নিছকই লেখক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার, একজন ক্রীড়াবিদ, একজন অনুসন্ধানকারী, আর তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি ছিলেন এক অসাধারণ গল্পকার, যার জীবনে গল্পের অভাব ছিল না! তার জীবনই ছিল এক অনবদ্য উপন্যাস, যা আজও আমাদের মুগ্ধ করে। লেখক হিসেবে তিনি অমর। শার্লক হোমস এক কাল্পনিক চরিত্র হলেও, তার প্রভাব বাস্তব পৃথিবীতে গবেষণাগারে, গোয়েন্দা বিভাগে, এমনকি আমাদের চিন্তাধারাতেও। ডয়েলের কলমের ধারা এমনভাবে আমাদের মস্তিষ্কে মিশে আছে যে, অনেক সময় হোমসকে বাস্তব ব্যক্তি ভাবতেও দ্বিধা হয় না।

আহ, শার্লক হোমস! শুধু একটা নাম নয়, একটা রহস্য, একটা কৌতূহল আর অদম্য যুক্তির প্রতিচ্ছবি! স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের এই অমর সৃষ্টি গত দেড়শ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। বুক রায়ট-এর বাছাই করা সেরা ১০টি গল্পের তালিকা দেখে নিশ্চয়ই আপনার রহস্য রোমাঞ্চের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেছে, তাই না?

কেন শার্লক হোমস জনপ্রিয়

শার্লক হোমসকে ঘিরে পাঠকের উন্মাদনা শুধু কিছু রোমাঞ্চকর গল্পের জন্য নয়। এর পেছনে আছে বেশ কিছু দারুণ কারণ :

হোমসের বুদ্ধি : হোমসকে মানুষ ভালোবাসে তার তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর অসামান্য যুক্তিবুদ্ধির জন্য। সাধারণ মানুষের চোখে যা শুধুই বিশৃঙ্খলা, হোমস সেখানে খুঁজে পান সুতোয় বাঁধা এক জ্যামিতিক নকশা। ছোট ছোট সূত্র থেকে বিশাল বড় রহস্যের সমাধান টেনে বের করাটা যেন তার কাছে জলভাত!

ড. ওয়াটসনের চরিত্র : হোমসের পাশেই রয়েছেন তার বিশ্বস্ত বন্ধু এবং কাহিনীকার ড. জন ওয়াটসন। ওয়াটসন যেন আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি হোমসকে নিয়ে প্রশ্ন করেন, তার অদ্ভুত অভ্যাসগুলোকে মেনে নেন, আর হোমসের প্রতিভার সাক্ষী হয়ে সব কিছু আমাদের কাছে তুলে ধরেন। ওয়াটসন না থাকলে হোমসের চরিত্র হয়তো এত পূর্ণতা পেত না।

ভিক্টোরীয় লন্ডনের পটভূমি : গল্পগুলোর পটভূমি হলো কুয়াশাচ্ছন্ন, রহস্যময় ভিক্টোরীয় লন্ডন। বেকারি স্ট্রিটের ২১বি নম্বরের সেই বিখ্যাত অ্যাপার্টমেন্ট, ঘোড়ার গাড়ির শব্দ, পুরনো বইয়ের গন্ধ এ সবকিছুই পাঠককে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। সেই সময়ের অপরাধ আর সমাজের চিত্রগুলোও খুব সুন্দরভাবে উঠে আসে গল্পে।

বৈচিত্র্যময় রহস্য : শার্লক হোমসের গল্পগুলোতে শুধু খুন আর চুরির ঘটনা থাকে না। থাকে সামাজিক সমস্যা, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং মানসিক দ্বন্দ্বে ভরা বিচিত্র সব রহস্য। প্রতিটি গল্পই নতুন এক ধাঁধা নিয়ে হাজির হয়।

সেরা গল্পগুলোর কয়েকটি

শার্লক হোমসের যে গল্পগুলো পাঠকের মনের মধ্যে স্থান পেয়েছে, সেগুলোর কিছু বিশেষত্ব একটু ছুঁয়ে দেখা যাক :

দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস : শার্লক হোমসের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। একটি অভিশপ্ত হাউন্ড কুকুরের কিংবদন্তি আর এক প্রাচীন পরিবারের রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে এর টানটান উত্তেজনা পাঠককে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ধরে রাখে। এটি হোমসের সেরা ক্ল্যাসিকগুলোর একটি।

এ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া : এই গল্পটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় কারণ এখানে হোমসের একমাত্র প্রেমের আগ্রহ, আইরিন অ্যাডলারের আবির্ভাব ঘটে। আইরিন এতটাই বুদ্ধিমতী ছিলেন যে, তিনি হোমসকেও পরাজিত করেছিলেন, যা হোমসের জীবনে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।

দ্য ভ্যালি অব ফিয়ার : এই উপন্যাসটি আমেরিকায় একটি গোপন সমাজের অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং হোমসের বুদ্ধিমত্তার দারুণ এক সংমিশ্রণ। এটি হোমসের চিরশত্রু প্রফেসর মরিয়ার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত।

দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সিক্স নেপোলিয়ন : এই গল্পটি এক অদ্ভুত ধারাবাহিক চুরির রহস্য নিয়ে। কেউ ধারাবাহিকভাবে নেপোলিয়নের আবক্ষ মূর্তি চুরি করছে আর ভেঙে ফেলছে। হোমসকে এই অদ্ভুত আচরণের পেছনের কারণ খুঁজে বের

করতে হয়। শার্লক হোমস শুধু একটি ফিকশনাল চরিত্র নয়, তিনি হয়ে উঠেছেন বুদ্ধিমত্তা আর যুক্তির এক জীবন্ত প্রতীক। আপনি যদি এখনো এই রহস্যময় জগতে ডুব না দিয়ে থাকেন, তবে বুক রায়টের এই তালিকাটি আপনার জন্য দারুণ একটি শুরু হতে পারে!

আপনার পছন্দের শার্লক হোমস গল্প কোনটি?

তবে লেখালেখির বাইরেও তার জীবনের যেসব দিক আমাদের বিস্মিত করে, তা-ই তাকে সত্যিকার অর্থে ‘সেরার সেরা’ করে তোলে। এমন একজন মানুষের জন্মদিনে তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়, গভীর শ্রদ্ধায়।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, আপনি শুধু হোমসের স্রষ্টা নন, আপনি আমাদের কল্পনার গতিপথ বদলে দেওয়া এক দিকনির্দেশক। আপনি নিজেই এক ‘অ্যাডভেঞ্চার’।

শুভ জন্মদিন, স্যার! আপনি সেরা। আপনার শার্লক হোমসও সেরা।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত