বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। বুধবার (২১ মে) রাতেও রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার এবং তথ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন ইশরাক হোসেন। এদিকে বৃহস্পতিবার (২২ মে) মেয়র পদ নিয়ে করা রিটের আদেশ দেওয়া হবে।
বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইল মোড়ে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ইশরাক হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছেন। তার দাবি, চক্রান্ত করে তাদের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।
ইশরাক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই মানতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। তাহলে কি আশা করা যায় যে এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে? তিনি আরও বলেন, আমরা কি আরেকটা স্বৈরাচারী সরকার তৈরি হতে দিতে পারি? আমরা হাসিনাকে যেভাবে বিদায় করেছি সেভাবে সব স্বৈরাচার সরকারকে বিদায় করতে পারব।’
ইশরাক বলেন, একটি নতুন দল, যাদের নিয়ে আমি আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু দল গঠন করার পর সরকারের মধ্যে এদের অংশ রয়ে গেল। কাজেই নিরপেক্ষ সরকার আমরা পাইনি। সরকারের মধ্যে অনেকেই আছে যারা বিএনপি যাতে নির্বাচনে ভালো করতে না পারে সে চক্রান্ত করছে।
মেয়র হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেয়র বুঝি না, এই সরকার নিরপেক্ষ নয় তা সবার সামনে উন্মোচিত। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমকে পদত্যাগ করতে হবে। তারা পদত্যাগ করে নিজেদের রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করুক, কিন্তু সরকারে থেকে এসব করা যাবে না।’
ইশরাক বলেন, ‘পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। যতদিন দাবি মানা হবে না ততদিন আমরা এখান থেকে যাব না। রাজনৈতিক দল হিসেবে ফসল ঘরে নিয়ে ঘরে যেতে হবে। দাবি আদায় না হলে আমরা ঘরে যাব না। আমাদের যে অপবাদ দেওয়া হয়, তা ষড়যন্ত্রের অংশ। কিন্তু বিএনপি মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।’
এদিকে বৃহস্পতিবার রিটের আদেশ ঘোষণা পর্যন্ত দলটির রাস্তায় বসে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর বিএনপির পাশপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। থানাভিত্তিক রোস্টার ভাগ করে নেতাকর্মীরা অবস্থান করবেন বলে জানা গেছে।
বুধবার সকাল ১০টা থেকে হাইকোর্টসংলগ্ন মৎস্য ভবন ও যমুনার প্রবেশমুখে (কাকরাইল মসজিদসংলগ্ন) অবস্থান নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ঢাকা মহানগর উত্তর, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের অনেক নেতাকর্মীও অংশ নেন। বিকেলের দিকে যমুনা অভিমুখে মিছিল নিয়ে গেলে কাকরাইল মোড়ে আটকে দেয় পুলিশ। সেখানে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে নানা স্লোগান দিচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
এর আগে সকাল থেকে আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট গেট, প্রেস ক্লাব ও শিক্ষা ভবনের মোড়ে জড়ো হন। পরে সবাই একসঙ্গে মৎস্য ভবনের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় চারদিকে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশপাশের সড়কে যানজট দেখা দেয়, যা পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আন্দোলনে নেমেছেন বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দাবি মেনে নিতে বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। এ সময়ের মধ্যে ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না এলে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তারা। মঙ্গলবার বিকেলে বিক্ষোভ কর্মসূচির সমন্বয়কারী সাবেক সচিব মশিউর রহমান ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না এলে কঠোর কর্মসূচি ও ঢাকা অচল করে দেওয়ার হুমকি দেন।
নাগরিক সেবা বন্ধ : এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে নগর ভবনে আন্দোলন চলছে। তবে গতকাল নগর ভবন এলাকা অনেকটাই ফাঁকা ছিল। কিন্তু সবকটি ফটকে তালা দিয়ে রাখার কারণে কোনো দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। পাশাপাশি যে আটটি আঞ্চলিক অফিস নগর ভবনের বাইরে রয়েছে, সেগুলোও ছিল বন্ধ। অন্যান্য দিনের মতো সেবা পেতে এসে ফিরে গেছেন নগরবাসী। কর্মচারীরাও অলস সময় পার করছেন। অনেকেই অঘোষিত ‘ছুটি’ উদযাপন করছেন।
ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই নগর ভবনের ভেতরকার সব নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। আজ (গতকাল) নগর ভবনের বাইরের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোও বন্ধ রয়েছে। এর ফলে আমরা কোনো নাগরিক সেবা ঢাকা দক্ষিণ সিটির নাগরিকদের দিতে পারছি না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবেন।’
আদালতের আদেশ বৃহস্পতিবার : বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসি মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট আবেদনের ওপর আদেশের ঘোষণার দিন পিছিয়ে আজ বৃহস্পতিবার নির্ধারণ করা হয়েছে। বুধবার বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আদেশের জন্য আজ দিন ধার্য করে।
মঙ্গলবার (২০ মে) এ-সংক্রান্তে শুনানি শেষে বুধবার আদেশের জন্য ধার্য করে আদালত। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বিষয়টি হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ইশরাকের আইনজীবী, রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষ শুনানিতে অংশ নেন। দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানি চলার পর আদালত আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন। ইশরাকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান মিলন।
গত ২৭ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম এক রায়ে ২০২০ সালের ডিএসসিসির মেয়র নির্বাচনের ফল বাতিল করে ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র হিসেবে সরকারের গেজেট বাতিল করে আদালত। ইশরাক হোসেন অবিভক্ত ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার (প্রয়াত) ছেলে ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ডিএসসিসির ওই নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অগ্রহণযোগ্যতার অভিযোগে নির্বাচনের ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ এ মামলাটি করেছিলেন ইশরাক।
ইশরাককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিন : আবদুস সালাম
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসি মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ পেশাজীবী জোটের উদ্যোগে ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
ঢাকা সিটির সাবেক ডেপুটি মেয়র সালাম বলেন, ‘সাত দিন ধরে ঢাকা মহানগর বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে। সরকারকে আমি বলতে চাই, কেন দেশটাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। দুয়েকজন উপদেষ্টার কারণে কি এ সরকার ব্যর্থ হবে? কোর্ট রায় দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে। এখন যদি ইশরাক মেয়রের চেয়ারে বসেন, তাহলে কার স্বার্থে আঘাত লাগবে?’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের গেজেট তো বাতিল করা হয়নি, তাহলে কেন ইশরাককে মেয়রের পদ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না?’