বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

নৈতিক অবক্ষয় রোধের উপায়

আপডেট : ২৪ মে ২০২৫, ০৩:৩০ এএম

নৈতিকতা সমাজের ভিত্তি এবং রাষ্ট্রের প্রাণ। নৈতিকতাবিবর্জিত সমাজ মানেই মূল্যবোধহীনতা, বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের এক অভিশপ্ত চিত্র। আজকের আধুনিক বিশে^ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জ্ঞানবিস্তারের অগ্রগতির পেছনে নৈতিক বিচ্যুতি দিন দিন বেড়েই চলছে। ব্যক্তি থেকে সমাজ সবখানেই নৈতিকতার অবক্ষয় আমাদের ভাবিয়ে তুলে। অথচ একটি সুস্থ, সুন্দর ও কল্যাণময় সমাজ গঠনের প্রধান শর্ত হলো নৈতিকতা ও চরিত্রের দৃঢ়তা। আর এই নৈতিকতা অর্জনের মৌলিক পথ হলো আত্মসচেতনতা।

আত্মসচেতনতা মানে শুধু নিজেকে আয়নায় দেখার বিষয় নয়, বরং এটি একটি গভীর আত্মজিজ্ঞাসা ‘আমি কে?’, ‘আমার দায়িত্ব কী?’, ‘আমার সঠিক পথ কোনটি?’ এবং ‘আমি কেন ভুল করছি?’, এই প্রশ্নগুলোর সৎ উত্তর খুঁজে পাওয়ার অন্তর্দর্শনই হলো আত্মসচেতনতা। ইসলাম যেভাবে আত্মশুদ্ধি ও নফসের পরিশুদ্ধির ওপর জোর দেয়, তা মূলত নীতিবান এক মানবসম্প্রদায় গঠনের নির্দেশনাই দেয়। পবিত্র কোরআন বারবার মানুষকে তার ভেতরের জগৎ নিয়ে চিন্তা করতে, নিজের ভুল-ত্রুটি অনুধাবন করতে এবং সংশোধনের চেষ্টা করার আহ্বান জানায়।

একজন মানুষ যখন নিজের ভেতরের দুর্বলতা, স্বভাবগত প্রবণতা ও আবেগগত বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন হয়, তখনই সে প্রকৃতভাবে সঠিক ও ভুলের ফারাক নির্ধারণ করতে পারে। মনোবিজ্ঞান বলছে, নিজের সম্পর্কে না জানার কারণে মানুষ নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং তখনই অপরাধপ্রবণতা ও নৈতিক বিচ্যুতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, একজন আত্মসচেতন মানুষ জানে কোনটি কল্যাণময়, কোনটি ধ্বংসাত্মক। তাই সে নিজের চিন্তা, কর্ম ও আচরণে দায়িত্বশীল থাকে। নৈতিক অবক্ষয়ের বর্তমান প্রেক্ষাপট, এর অন্তর্নিহিত কারণ এবং কীভাবে আত্মসচেতনতার মাধ্যমে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব, তা উল্লেখ করা হলো।

নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। কোনো মুসলমানের জন্য এটা শোভা পায় না যে, সে নৈতিকতা বর্জন করে বিপথে চলবে। তাহলে সে নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে। তার পরকাল হবে ভয়াবহ কঠিন। এমন ক্ষতি থেকে বাঁচতে সব মুসলমানের উচিত আত্মসচেতন হওয়া। কেননা আত্মসচেতন না হলে নৈতিক উন্নতি সাধন করা যায় না।

আত্মসচেতনতার অর্থ হলো নিজেকে চেনা, নিজের সম্পর্কে জানা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মনোবিজ্ঞানীরা সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক আচরণগত স্খলন সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বেশিরভাগ নৈতিক অবক্ষয় ও স্খলনের কারণ হলো নিজের সম্পর্কে না জানা। সাফল্যের প্রভূত দিক, যা নিজের ভেতরে রয়েছে সেগুলো উপলব্ধি করতে না পারা। এ রকম অসচেতন মানুষ নিজের ব্যাপারে দোদুল্যমান থাকে। সে কোনোভাবেই নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। কীসে কল্যাণ আর কীসে ধ্বংস, সেটা নির্ধারণ করার শক্তি সে হারিয়ে ফেলে। ফলে সে ভুল করে, নানা ধরনের অপরাধে জড়ায়।

বিষয়টি অন্যভাবে বলা যায়, যে নিজেকে চেনে না, সে অনেকটা নাবালকের মতো। বাইরের চাকচিক্য ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো তাকে সহজেই একবার এদিকে আবার ওদিকে আকর্ষণ করে। যে আকর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে সে অস্থিরতায় ভোগে। বর্ণিত অবস্থায় বলা যায়, যদি সে নিজেকে চিনত, নিজের মন-মানসিকতার ওপর দৃঢ় থাকত তাহলে সে অন্যায় কাজে জড়াত না। অবক্ষয়কে ঘৃণা করত, নৈতিক স্খলনের পথ এড়িয়ে চলত। সুতরাং পাপে না জড়ানোর জন্য, মনোদৈহিক প্রশান্তি ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দৃঢ় মনোবল থাকার নেপথ্য উপায় হলো নিজেকে চেনা।

দুনিয়ার প্রায় মানুষই তার নিজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উদাসীন। কিন্তু আত্মসচেতনতার মধ্য দিয়েই সেসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ মেলে। ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, নিজেকে চেনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নিজের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি ও জীবনাচারের ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলো উপলব্ধি করা। এ উপলব্ধির প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো, নিজের ভুলভ্রান্তিগুলোকে চেনা, দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিজের অসন্তুষ্টি কিংবা ব্যর্থতার ব্যাপারে জানা। কারণ মানুষের আচার-ব্যবহার, অনুভূতি, দৃষ্টিভঙ্গি সবই নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিগত বোধ-বিশ্বাসের ওপর। আর আমাদের সব ব্যর্থতা ও সাফল্যের নেপথ্য চালিকাশক্তি এগুলোই। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, নিজেকে চেনার পন্থাগুলো অর্জন করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে গঠনমূলক ও সুন্দর ব্যবহার, দায়িত্বশীল আচরণ ও আত্মসম্মানের বীজ।

যুগে যুগে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবী-রাসুল ও মনীষীরা নিজেকে চেনার দিকেই আহ্বান জানিয়েছেন সমাজের মানুষকে। এমনকি আসমানি কিতাবগুলোর বিষয়বস্তুও অধিকাংশ এ বিষয়ে। ইসলাম মনে করে, যে নিজেকে জানল, সে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে জানল।

ইসলামি স্কলাররা নিজেকে চেনার শিক্ষাকে সবচেয়ে উত্তম ও উপকারী শিক্ষা বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, নফস মানে আমিত্ব, আমার ব্যক্তিত্ব, আমার আত্মা। সুতরাং নফসকে যদি চেনা না যায়, তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচয় ও শিক্ষা মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে না, এসবের ভালোমন্দ কিংবা উপকার-অপকারের দিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হবে।

পৃথিবী ও পরকালীন জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে। কোরআনে কারিম মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে নিজেকে নিয়ে এবং এই বিশ^চরাচর নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মধ্য দিয়ে সৌভাগ্য ও সাফল্যের পথ খুঁজে নেওয়ার। কোরআনে কারিম একইভাবে গভীর চিন্তাভাবনাকে ইবাদত বলে উল্লেখ করেছে। চিন্তা করার জন্য চিন্তাশীলদের আহ্বান জানিয়েছে বারবার, নানাভাবে, বিভিন্ন উপলক্ষে।

মানুষের চিন্তা-চেতনাগত ভ্রান্তি ও অবক্ষয়ের পেছনে রয়েছে নিজেকে না চেনা এবং এই বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকা। এ দুয়ের জ্ঞানহীনতাই মূলত সব ধরনের ভুলভ্রান্তি ও নৈতিক স্খলনের মূল উৎস। ভুল স্বীকার করে সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে সমালোচনা গ্রহণের মনমানসিকতা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে নিজের ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিত্ব আরও বেশি মূল্যবান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রকৃত মুমিন-মুসলিমরা এ গুণে গুণান্বিত হোক, এটাই ইসলামের চাওয়া।

ইসলাম মনে করে, সমালোচনা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা বাড়ে। সুতরাং মানুষ যদি চায় সুস্থ জীবনযাপনের পথে পা বাড়িয়ে সৌভাগ্য, কল্যাণ ও সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে, তাহলে তাদের উচিত আত্মসচেতন হওয়া অর্থাৎ নিজেকে চেনা। কোরআনে কারিমের দৃষ্টিতে মানুষের আত্মসচেতনতা সরাসরি মানুষের বোধবিশ্বাস, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, বুদ্ধি-বিবেক এবং মেধার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই নিজের সম্পর্কে মানুষ যত বেশি জানবে, মানুষের চিন্তার গভীরতা তত বাড়বে। আর এটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ও সাফল্য।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত