শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বর্জ্য-বিষ নিয়ে বুড়িগঙ্গা তুমি বইছ কেন... 

আপডেট : ২৪ মে ২০২৫, ০১:৩৩ এএম

‘গঙ্গা বুড়ি গঙ্গা বুড়ি শোনো, এত সুন্দর নামটি তোমার কে দিয়েছে বলো।’ আশির দশকের কবি কফিল আহমেদের এই গান মনে করিয়ে দেয় বুড়িগঙ্গা নদী কতই না সুন্দর ছিল। ৪০০ বছর আগে যে নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা। সেই তিলোত্তমা ঢাকাই এখন তিলে তিলে মারছে সভ্যতার সাক্ষী বুড়িগঙ্গাকে... 

বুড়িগঙ্গা এখন দেখতে কেমন? কেমন তার পানিপ্রবাহ? কত দখল, কত দূষণ সইতে হয় এই নদীকে তা বলাবাহুল্য। সমুদ্রে তিমি মাছ যখন শরীরে আস্তরণ (বর্ণাকল) নিয়ে ছটপট করে, তখন মানুষ দেখলে ছুটে আসে। মানুষ তার শরীর থেকে আস্তরণ সরিয়ে যন্ত্রণা লাঘব করে। কিন্তু এত এত বর্জ্য-বিষ নিয়ে ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বুড়িগঙ্গা কার কাছে যাবে? গত দুই যুগে কয়েকবার সরকার পরিবর্তন হলেও বুড়িগঙ্গা রক্ষায় উল্লেখযোগ্য কাজ করেনি কেউ।

এক সময়ের টলটলে বুড়িগঙ্গার পানির এখন বিষাক্ত। পানির প্রতিটি ফোটায় বিষ। বিষের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, ময়লা খেকো ‘সাকার ফিস’ মরছে সেই পানিতেই। এখন বুড়িগঙ্গায় ‘সাকার ফিস’ আর নেই। কীভাবে এমনটা হলো? বুড়িগঙ্গা দূষণে হাজারো কারণ রয়েছে। একদিনে নয়, বহুদিনের ধারাবাহিক অবহেলা, অপরিকল্পনা, প্রভাবশালীদের স্বেচ্ছাচারিতাও রয়েছে ওই হাজারো কারণে। 

রিভার আন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচর থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে ২৫টি সুয়ারেজের পাইপলাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত বর্জ্য এসে বুড়িগঙ্গায় পড়ে। বুড়িগঙ্গার প্রায় ৪০ শতাংশ দূষণই হচ্ছে এই পাইপলাইনগুলোর মাধ্যমে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে এই পাইপলাইনগুলো পাগলা পয়ঃশোধনাগারে স্থানান্তরের পরামর্শ দেওয়া হয়। মাত্র ২৫-৩০ কোটি টাকা ব্যয়েই এটি সম্ভব বলে জানানো হয়। কিন্তু...

২০২৪ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিদিন ১৬০ কোটি লিটার তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ কল-কারখানার ও ৪০ শতাংশ বাসা-বাড়ির বর্জ্য। বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। জীববৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে। মাছ নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার প্রায় ৪৫০ একর জমি দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধ ইট-বালুর ঘর, বসতবাড়ি, দোকানপাট, এমনকি সরকারি স্থাপনাও।

গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকা ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনার ছড়াছড়ি। কিন্তু ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা রক্ষায় নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। বুড়িগঙ্গা রক্ষায় বিগত সরকারের আমলে যত প্রজেক্ট করা হয়েছে এবং যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে, সেগুলো আসলে খরচ করা হয়েছে কি না, নাকি বেশিরভাগই দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান, ড্রেজিং, ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ ছিল কিছু সময়ের জন্য। ধারাবাহিকতা ছিল না। ফলে কিছু দিন পরপরই আগের মতোই দখল হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা।

সরেজমিন বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, দুই তীরের বাসা-বাড়ির ও কল-কারখানার বর্জ্য সরাসরি এসে পড়ছে নদীতে। এ ছাড়া লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলারসহ অন্যান্য নৌযানগুলোর তেল মবিল ও বর্জ্য তো আছেই। পানি না কালো তেল দেখে বোঝার উপায় নেই। মনে হয় ‘বুড়িগঙ্গা যেন ভাসমান এক ময়লার ভাগাড়।’

গত ৩০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইছেন আ. রহিম মিয়া। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৯৯৭-৯৮ সালের পর থেকে বুড়িগঙ্গার পানি আস্তে আস্তে খারাপ হতে শুরু করে। নৌকা বাইতে গিয়ে পানি পিপাসা পেলে এক সময় আমরা নদীর পানি পান করেছি, গোসল করেছি। এখন পানির দিকে তাকানো যায় না।

কেরানীগঞ্জের আগানগরের স্থায়ী বাসিন্দা সায়েম বলেন, এক সময় এই নদীতে মাছ ধরেছি। এখন তো পানি খেলেই কেমন লাগে। কত সরকার আসে, কত যায়, বুড়িগঙ্গা রক্ষায় কত প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো কাগজে-কলমেই। বর্তমান সরকারের উচিত ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে দ্রুত ব্যবস্থা হাতে নেওয়া।

সাদ্দাম হোসেন নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, বুড়িগঙ্গা এখন নিজের বুকে বিষ বহন করছে। সরকারের প্রতিটি দপ্তরের হয়তো বুড়িগঙ্গা নিয়ে ফাইলে ফাইলে পরিকল্পনা আছে কিন্তু কার্যকারিতা নেই।

আব্দুল্লাহ নামে ওয়াইজঘাট এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, বিগত সরকার ঘোষণা দিয়েছিল বুড়িগঙ্গাকে টেমস নদী করবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। দুই পাড়ের যত ময়লা আছে সব এখানে ফেলা হয়। কেরানীগঞ্জের যত অবৈধ ডায়িং কারখানা আছে সবগুলোর বিষাক্ত কেমিক্যাল এই নদীতে পড়ে। এই সরকারের কাছে দাবি, নদীকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নেওয়া হোক। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী বাঁচাতে দরকার আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

বুড়িগঙ্গা রক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, বিগত সময়ের সরকাররা বুড়িগঙ্গা নিয়ে যত পদক্ষেপ নিয়েছে তা শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে, আর অনেক টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক রূপে কাজ কিছুই হয়নি। বুড়িগঙ্গা রক্ষা করতে হলে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ পরিকল্পিত প্ল্যান দরকার। সিটি করপোরেশনের বর্জ্য, ওয়াসার বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এ ছাড়া পলিথিন জাতীয় বর্জ্যও বুড়িগঙ্গায় বেশি রয়েছে। এগুলো শোধন না করা হলে আর বর্জ্য যদি সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ে তাহলে কিছুতেই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো সম্ভব না।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবেশবিষয়ক ও দেশের নদীগুলো বাঁচাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আশাবাদী বর্তমান সরকার বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ দ্রুত সময়ের মধ্যই নেবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের অন্যান্য নদীর দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখা কাজ করছে। এ ছাড়া দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত