সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পুরনো দিনের হজ-কথা

আপডেট : ০৪ জুন ২০২৫, ১২:৩০ এএম

একসময় মক্কা-মদিনার পথে হজের যাত্রা ছিল এক দীর্ঘ ও কঠিন সফর। লোহিত সাগরের তীর থেকে মরুভূমির ধূসর প্রান্তর পেরিয়ে পবিত্র ভূমিতে পৌঁছানো ছিল বিশ্বাস আর ধৈর্যের পরীক্ষা। সেই সময়ের হজের কথা লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

লোহিত সাগরের তীরে জেদ্দা বন্দর, যেন মক্কা নগরীর বিশাল এক ফটক। কত কালের কত স্মৃতি এই বন্দরের বুকে! কত দেশ থেকে সওদাগররা তাদের পণ্য নিয়ে এখানে ভিড় জমিয়েছেন। ভারতবর্ষের লোকেরাও পিছিয়ে ছিল না। তাদের জাহাজে থাকত এলাচ, লবঙ্গ, মুক্তা, দামি পাথর আর রেশমের মতো কত না মূল্যবান জিনিস! শোনা যায়, সেই সিন্ধু বিজয়ের সময় থেকেই (৬৬৪ থেকে ৭১২ সাল) ভারতীয়দের হজ করার জন্য জেদ্দায় আসা-যাওয়া শুরু।

মোগল আমলের কথা ভাবুন। আমাদের দেশের মুসলিম ভাই-বোনেরা তখন হজ করতে যেতেন দুটো পথে। একটা ছিল অনেক দূরের পথ, হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারত পেরিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক হয়ে তবে পৌঁছানো যেত সৌদি আরবে। সে পথ ছিল বড়ই কষ্টের আর নানা রকম বিপদে ভরা। পথে নাকি সাফায়িদ শিয়া গোষ্ঠীর লোকেরা প্রায়ই হজযাত্রীদের কাফেলায় হামলা করত! তাই অনেকে লোহিত সাগরের পথ ধরতেন, সমুদ্রপথে যাওয়াটা ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ আর নিরাপদ। তবে সমুদ্রেও বিপদ কম ছিল না! ষোলো শতকে লোহিত সাগরের দখল ছিল পর্তুগিজদের হাতে। তাদের কাছ থেকে ‘কার্তাজ’ নামে এক ধরনের ছাড়পত্র নিতে হতো হজযাত্রী আর ব্যবসায়ীদের। এক সময় এই নিয়ম এতটাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল যে, মোগল আমলের বড় বড় আলেমরা পর্যন্ত বলেছিলেন, এমন অবস্থায় হজ ফরজ নয়!

তবে হ্যাঁ, ভালো সময়ও ছিল। মোগল বাদশাহরা যখন ভালো মেজাজে থাকতেন, তখন হজযাত্রীদের জন্য দারুণ সব ব্যবস্থা করতেন। কয়েকটা জাহাজ মিলিয়ে একটা নৌবহর তৈরি করতেন, যাত্রীদের থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব নিতেন তারা। শুধু তাই নয়, উসমানীয় খলিফারাও সিরিয়া আর মিসর থেকে আসা হাজিদের পথের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতেন। খলিফাদের তো বলা হতো ‘পবিত্র ভূমির তত্ত্বাবধায়ক’। গুজরাটের সুরাট শহরটা তখন ছিল যেন মক্কার প্রধান দরজা। নাম ছিল ‘বাব-আল মক্কা’ বা ‘বন্দরে মোবারক’। ভারতবর্ষের হজযাত্রীদের জন্য এটা ছিল খুব জরুরি একটা বন্দর। আর সম্রাট আকবর ছিলেন সেই প্রথম মোগল বাদশা, যিনি সরকারি খরচে বা ভর্তুকি দিয়ে হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি মক্কায় হাজিদের জন্য একটা থাকার জায়গাও বানিয়ে দিয়েছিলেন।

এক ভুলের ফল সুদূরপ্রসারী

জাহাঙ্গীরের আমলে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ১৬১৩ সালে, জাহাঙ্গীরের মা যোধা বাইয়ের মালিকানাধীন তীর্থযাত্রীবাহী বিশাল জাহাজ ‘রহিমী’, পর্তুগিজদের ছাড়পত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইউরোপীয়রা জানত, এটি বিশ্বের বৃহত্তম তীর্থযাত্রীবাহী জাহাজ। এই ঘটনায় মোগল সম্রাট অপমানিত হন। ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ নীতিতে তিনি ব্রিটিশদের প্রতি নরম হন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে ব্যবসার অনুমতি দেন। ভাবুন একবার, একটি হজের জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার কারণে ব্রিটিশরা আমাদের দেশে বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়ে গেল!

সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় প্রতি বছর দুটি সরকারি জাহাজ লোহিত সাগরে যেত, যেখানে যাত্রীদের কোনো খরচ লাগত না। মোগল হারেমের নারীরাও এতে হজে যেতেন। আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নেসা হজযাত্রীদের সাহায্য করতেন। পণ্ডিত সফী বিন ওয়ালী আল-কাজভিনীকে কুরআন তাফসীরের পুরস্কারস্বরূপ তিনি হজে পাঠিয়েছিলেন। সফী সাহেব ১৬৭৬ সালে ‘সালামাত রাস’ নামক জাহাজে মক্কার পথে যাত্রা করেন এবং তার সফরের কাহিনি ‘আনিসুল হজ’ নামে একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন, যা আজও মুম্বাইয়ের এক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মোগল বাদশাহরা শুধু ধার্মিকদেরই নয়, সন্দেহভাজন বা অপছন্দনীয় ব্যক্তিদেরও হজের নামে নির্বাসিত করতেন। যেমন আকবর বৈরাম খানকে এবং জাহাঙ্গীর তার ভুল করা পারসিক চিকিৎসক সাদরাকে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন। এমনকি আওরঙ্গজেবও নাকি এক বিরক্তিকর কাজীকে পদত্যাগ করিয়ে সোজা মক্কা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন!

ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে সম্রাট আকবরের মীর হাজি প্রতি বছর মক্কা ও মদিনার দরিদ্রদের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ টাকা বিতরণ করতেন এবং মক্কার শরিফের জন্য মূল্যবান উপহার পাঠাতেন। ১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেব শরিফের জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকার উপহার পাঠিয়েছিলেন। এত বিপুল সংখ্যক হজযাত্রী পাঠানো সত্ত্বেও কোনো মোগল বা উসমানীয় বাদশাহ ব্যক্তিগতভাবে হজ করার সুযোগ পাননি, কারণ দীর্ঘ সময়ের জন্য রাজধানী ত্যাগ করা শত্রুদের সুযোগ করে দিত। তবে কিছু মহীয়সী নারী ঠিকই হজ করেছেন। আকবরের ফুফু গুলবদন বেগম ১৫৭৬ সালে এবং ভূপালের সিকান্দার বেগম ১৮৬৩ সালে ১৫০০ সঙ্গী নিয়ে হজ করেন এবং প্রথম সম্রাজ্ঞী হিসেবে ‘হাজি’ খেতাব পান। শোনা যায়, তিনি পুরো রাস্তায় অর্থ বিতরণ করেছিলেন এবং মক্কায় পৌঁছালে সেখানকার শরিফ তাদের জন্য ৫০ প্রকারের রাজকীয় খাবার পাঠিয়েছিলেন!

১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার হজের জন্য ‘টমাস কুক অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি এজেন্সি নিয়োগ করে, যারা হজযাত্রীদের পরিবহন, পাসপোর্ট ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিত। ১৯২৭ সালে বোম্বেতে হজ কমিটি গঠিত হয়, যা ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত কাজ করে। হজযাত্রীদের সুবিধার জন্য ১৯৫৯ সালে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ‘এইচএ’ নম্বরযুক্ত বিশেষ ১০ ও ১০০ রুপির নোট চালু করে। পাকিস্তানও ১৯৫০ সালে একই রকম হজ নোট চালু করেছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোগল লাইন শিপস একাই ১৯২৭ সালে ২০ হাজার হজযাত্রীকে মক্কায় পৌঁছে দিয়েছিল!

দীর্ঘ পথের যাত্রী

আজ থেকে কয়েক দশক আগেও বাঙালি মুসলমানের হজের স্বপ্ন দেখা ছিল দুষ্কর। আর্থিক সামর্থ্য আর শারীরিক সক্ষমতা না থাকলে এই পবিত্র সফর ছিল প্রায় অসম্ভব। সমাজে হাজি সাহেবদের ছিল বিশেষ মর্যাদা, তাদের নামে গ্রামের নামকরণ পর্যন্ত হতো। বিগত শতাব্দীর শেষভাগেও হজের প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল। পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে, দেনা-পাওনা মিটিয়ে তবেই হজযাত্রীরা আল্লাহর পথে পা বাড়াতেন। প্রবীণরাই ছিলেন এই পথের যাত্রী বেশি, কারণ দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল পথ, রোগ-শোকের ভয় ছিল প্রবল। অনেকে আর ফিরে আসার আশা রাখতেন না, কেউ কেউ মক্কা-মদিনায় শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করার আকাক্সক্ষা পোষণ করতেন। আবার কারও মনে হতো, হজের পর আর সংসারের ঝামেলায় জড়াবেন না। কবি আল মাহমুদ আক্ষেপ করে বলেছেন, আমাদের অঞ্চলে বয়স্করাই হজে যান, অথচ মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার তরুণরাও বিয়ে করেই হজ করেন। হাজি সাহেবদের বিদায় জানানো হতো উৎসবের আমেজে, আত্মীয়-স্বজন অশ্রুসিক্ত নয়নে এগিয়ে দিতেন। নবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠাতেন সবাই, সেই সালাম মদিনার রওজায় পৌঁছে দেওয়ার ভার থাকত হাজির ওপর। উপমহাদেশের বাঙালি হজযাত্রীরা পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়িতে বা নৌকায় করে পৌঁছাতেন বোম্বে (মুম্বাই) বন্দরে। সেখানে থাকত পেশাদার পথপ্রদর্শক। অনেকের যাত্রা বোম্বেতেই থেমে যেত অসুস্থতা বা জাহাজ মিস করার কারণে, তারা ‘বোম্বাই হাজি’ নামে পরিচিত হতেন।

হজের জাহাজ বোম্বে থেকে প্রথমে যেত করাচি, তারপর আরব সাগর পেরিয়ে এডেন। সমুদ্রযাত্রায় ঝড়-বৃষ্টি ছিল নিত্যসঙ্গী। ১৯১২ সালে হজে যাওয়া খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ তার সমুদ্রযাত্রার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। জাহাজের শ্রেণি, টিকিটের দাম, নিজেদের রান্না করা, পথে খাদ্য ও জলের অভাব, এমনকি সোকোট্টার কাছে ভয়াল সমুদ্রের রূপের কথা। ঝড়ো হাওয়ায় জাহাজের বাসনপত্র ভেঙে গিয়েছিল, রাতের অন্ধকারে মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন তিনি। ডেকের যাত্রীদের কষ্টের চিত্রও তিনি তুলে ধরেছেন। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সমুদ্রযাত্রা মনোরমও হতো, যেখানে উপকূলের আলো আর সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য যাত্রীদের মুগ্ধ করত।

এডেনে নেমে হজযাত্রীদের পাঠানো হতো কামারানে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। এরপর গন্তব্য জেদ্দা, যেখানে পৌঁছানোর আগে ইয়ালামলামে ইহরাম বাঁধা ছিল অপরিহার্য।

ধুলো, তৃষ্ণা আর অজানা ভয়

জেদ্দা থেকে মক্কা বা মদিনার পথ ছিল বন্ধুর। একদিকে সূর্যের প্রখর তাপ, অন্যদিকে বেদুইন ডাকাতদের আনাগোনা। সুযোগ পেলেই তারা কাফেলায় হামলা করত। খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ মদিনার পথে ৩০০ উটের কাফেলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। শত্রুর ভয়ে রাতেও পথচলা, মঞ্জিলে পৌঁছানোর পর বিশ্রাম এবং রাতের অন্ধকারে ডাকাতদের উৎপাত, যাদের উৎকোচ দিতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে যেতেন। এমনকি একজন যাত্রীর আঙুল কেটে নেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটেছিল।

শুধু ডাকাত নয়, পথে জল আর খাবারের অভাবও ছিল নিত্যসঙ্গী। খাবার ফুরিয়ে গেলে কাফেলার লোকেরা আশ্রয় নিত স্থানীয় আরবদের বাড়িতে, যারা ছিলেন অতিথিপরায়ণ।

তৃপ্তির চোখে কাবা দেখা

সব কষ্ট, ভয় আর দীর্ঘ পথের শেষে হাজিরা যখন মক্কার পবিত্র ভূমিতে পৌঁছাতেন, তখন তাদের চোখে অশ্রু এসে যেত। কতজন যে একসঙ্গে তাকবির পড়ে কাঁদতেন! তখনকার কাবা ছিল অনেকটা সরল রূপের চারপাশে আধুনিক অট্টালিকা ছিল না। হজের সময় হাজীদের থাকার জায়গা ছিল সাধারণ তাঁবু, কারও ভাগ্যে থাকত স্থানীয় কোনো পরিবারের আতিথ্য। পানি ছিল অমূল্য সম্পদ, তাই জমজম কূপের পানি সংগ্রহ করাই ছিল অনেকের প্রথম কাজ।

তাওয়াফের সময় কাবার চারপাশে যে আবেগ ও নিষ্ঠার আবহ তৈরি হতো, তা আজকের ডিজিটাল হজযাত্রায় আর পাওয়া যায় না বলেই অনেকে আফসোস করেন। অনেক হাজি নিজে হাতে লিখে রাখতেন হজের স্মৃতি, সেসব হজনামা আমাদের কাছে একেকটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে। আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বা সৈয়দ শামসুল হকের মতো লেখকরা পরে সেই সময়ের হজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন, যেখানে রয়েছে আধ্যাত্মিক বর্ণনা আর বাস্তব কষ্টের কথা। আজকের দিনে বিমানযাত্রায় ৬ ঘণ্টায় হাজি পৌঁছান জেদ্দায়। মোবাইল ফোনে সরাসরি ভিডিও কলে পরিবারকে দেখাতে পারেন জমজমের পানি পান করার মুহূর্ত! ডিজিটাল হজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবকিছু এখন অনেক সহজ হয়েছে। তবু এতসব প্রযুক্তি আর উন্নত ব্যবস্থাপনার পরেও, কেউ যদি খানিক থেমে পুরনো দিনের সেই কাফেলা-ভরা হজের কথা মনে করেন কষ্ট, সাহস আর ইমানের যে গল্পেরা একেকটি মহাকাব্যে পরিণত হয়েছে তাহলে বুঝতে পারবেন, সেকালের হজ মানে শুধু ভ্রমণ নয়, ছিল নিজেকে ত্যাগ করার, নিজেকে আল্লাহর হাতে সঁপে দেওয়ার এক পবিত্র সফর।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত