গাজার দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিতর্কিত মানবিক সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রের আশপাশে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে গত তিন দিনে অন্তত ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইনের ‘সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের উপাদান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। বিবিসি। ‘নাগরিকদের জন্য খাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী সাহায্য পেতে ইচ্ছাকৃত বাধা দেওয়া একটি যুদ্ধাপরাধ হতে পারে’, বলেছেন ভলকার তুর্ক। ‘ক্ষুধার হুমকি, ২০ মাস ধরে নাগরিক হত্যা ও ব্যাপক ধ্বংস, পুনঃপুনঃ নির্দয় বাস্তুচ্যুতি, অমানবিক ও অপমানজনক ভাষা এবং ইসরায়েলি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে গাজা উপত্যকাকে জনশূন্য করার হুমকিও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের উপাদান হতে পারে।’ গত তিন দিন ধরে বহু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি গুলিতে নিহত হয়েছেন, যখন তারা একটি বিতর্কিত, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন পরিচালিত সাহায্যকেন্দ্র থেকে খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। ক্ষুধার্ত এবং হতাশাগ্রস্ত নাগরিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলাকে ‘অসহনীয়’ আখ্যা দিয়ে তুর্ক বলেন, এসব হামলার প্রতি একটি ‘দ্রুত ও নিরপেক্ষ’ তদন্ত হওয়া উচিত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
‘নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হামলা আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন এবং একটি যুদ্ধাপরাধ’, তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সামনে রয়েছে সবচেয়ে ভয়ংকর দুটি বিকল্প ক্ষুধায় মারা যাওয়া অথবা সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টায় নিহত হওয়া।’ তুর্ক স্মরণ করিয়ে দেন যে, ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজে ইসরায়েলকে বাধ্যতামূলক নির্দেশ দিয়েছে যেন তারা অবিলম্বে, জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতায়, গাজায় সব ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, আশ্রয়, পোশাক, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা বাধাহীনভাবে সরবরাহ করে। তিনি বলেন, ‘এই নির্দেশ পালনে ব্যর্থতার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।’ রবিবার ভোরে জিএইচএফের ঘোষণা অনুযায়ী, সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রটি সকাল ৫টা থেকে চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা জানায়, সাইটটি বন্ধ থাকবে। এরই মধ্যে শত শত ক্ষুধার্ত মানুষ আল-আলাম রাউন্ডঅ্যাবাউট এলাকায় জড়ো হয়। পরে সেখানে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৩১ জন নিহত হন বলে হামাস পরিচালিত গাজা সিভিল ডিফেন্স জানায়। সোমবার একই এলাকায় আবার তিনজন নিহত হন। মঙ্গলবার সকালে আরেক দফায় গুলি চালালে আরও ২৭ জন নিহত হন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে।
বিবিসির তথ্য যাচাইকরণ দল বিবিসি ভেরিফাই কিছু ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে, যাতে গুলির শব্দ, বিস্ফোরণ ও আহতদের পড়ে থাকতে দেখা যায়। যদিও সব ভিডিওর অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি, কিছু ফুটেজ আল-রাশিদ সড়কের কাছাকাছি জায়গায় ধারণ করা হয়েছে বলে চিহ্নিত হয়েছে। রবিবার ভোরে, এসডিএস খোলার ঘোষণা দেয় জিএইচএফ, কিন্তু এক ঘণ্টা পর ঘোষণা দেয় এটি বন্ধ থাকবে। এ সময় বহু গাজাবাসী আল-আলাম রাউন্ডঅ্যাবাউটে জড়ো হয়েছিলেন। একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে ৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শোনা যায়। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সমুদ্রসৈকতে কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে আছে, যার মধ্যে একজন সম্ভবত যুবতী নারী। চিকিৎসকদের সরবরাহ করা ছবি অনুযায়ী, নিহতদের শরীর থেকে ৫.৫৬ মিমি এবং ৭.৬২ মিমি গুলির খোসা পাওয়া গেছে যা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি উভয় বাহিনীর অস্ত্র থেকে আসতে পারে। সোমবার আইসিআরসি জানায় এসডিএস১-এর কাছে তিনজন খাদ্যের অপেক্ষায় নিহত হন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা ১ কিমি দূরে সতর্কতামূলক গুলি ছুড়েছিল। মঙ্গলবার, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায় আরও ২৭ জন নিহত হয়েছেন। বিবিসি ভেরিফাই একটি ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে, যেখানে মানুষ দৌড়াচ্ছে এবং গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস জানিয়েছে, তাদের রাফাহ ফিল্ড হাসপাতাল মঙ্গলবার ভোরে ‘মাস ক্যাজুয়ালটি’ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। তারা ১৮৪ জন রোগী গ্রহণ করেছে, যাদের মধ্যে ২৭ জন ঘটনাস্থলে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স এজেন্সির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বিবিসিকে বলেন, আল-আলম গোলচত্বর থেকে কয়েকশ মিটার দূরে আবারও ঘটনাটি ঘটেছে। তিনি বলেন, নিহত বা আহতদের বেশিরভাগই ‘ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার এবং কোয়াডকপ্টার ড্রোনের গুলিতে আহত হয়েছেন।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের সেনারা সাইটের আশপাশে নয় বরং এক কিলোমিটার দূরে ‘সন্দেহভাজনদের’ লক্ষ্য করে সতর্কতামূলক গুলি চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে, কোনো বেসামরিক নাগরিককে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়নি এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনেক খবর ‘ভুল ও বিভ্রান্তিকর।’ জিএইচএফও দাবি করেছে, ‘আমাদের বিতরণ কেন্দ্রের ভেতরে কোনো হতাহত বা সহিংসতা ঘটেনি। আমাদের সাইট ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি অকার্যকর এবং সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই বিতরণ পদ্ধতির মাধ্যমে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারা ইসরায়েলকে আইসিআইর নির্দেশনা অনুযায়ী অবিলম্বে পূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরি সহায়তা পৌঁছাতে আহ্বান জানিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন নৃশংসতা আর কত দিন চলবে?
লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক