বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ অনেক দিনের। শুধু গৃহস্থালি বর্জ্যই নয়। অভিযোগ আছে শিল্পবর্জ্য, ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে ব্যাপারেও। বর্জ্যরে শ্রেণিবিন্যাস এবং এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবার জন্য মানুষ আছে। আমার ভাবনা একজন নাগরিক হিসেবে। নিউ ইয়র্কে বসবাস করতে গিয়ে এখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জানার সুযোগ হয়েছে। এই শহরে বাস করতে এ নিয়ে জানতেই হবে। কারণ নিউ ইয়র্ক শহরের বাসিন্দা হিসেবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে যেতেই হয়। এই ব্যবস্থাপনার একটা বড় দায়িত্ব পালন করেন বাসিন্দারা। শহরের বাসিন্দারা এই দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে স্যানিটেশন বিভাগ নিয়মিতভাবে অর্থ জরিমানা করে থাকে। নিউ ইয়র্কে আপনার বাড়ির সামনের ফুটপাত এবং ফুটপাত সংলগ্ন রাস্তার কিছু অংশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায় আপনার। যে কারণে সবাই সেই অঞ্চলটা ঝাড়ু দিয়ে, ব্লোয়ার দিয়ে কিংবা পাওয়ার ওয়াশ দিয়ে পরিষ্কার রাখে। তুষার ঝরা দিনে তুষার পরিষ্কার করে। এমনকি অন্যের ময়লা আবর্জনা, ডাল-পাতা, উড়ে এসে আপনার বাসার সামনে এসে পড়ে থাকলেও, সেটি পরিষ্কার করার দায়িত্ব আপাতত আপনারই। তা ছাড়া আপনার যদি বড় বড় আইটেম যেমন খাট, আলমারি, সোফা ফেলতে হয়, তখন অনলাইন কিংবা ফোনে স্যানিটেশন বিভাগের দেওয়া সময়সূচি মতো সেগুলোকে আপনার বাসার সামনে নির্দিষ্ট জায়গায়, এমনভাবে জড়ো করে রাখতে হবে যাতে পথচারীদের অসুবিধা না হয়। সপ্তাহে দুদিন করে আমাদের ময়লা ফেলতে হয়। একদিন রেগুলার গার্বেজ যেমন, কিচেনের ময়লাসহ ঘরের অন্যান্য আবর্জনা। আরেক দিন যেগুলোকে রিসাইকেল করা যায় যেমন কাগজ, কাগজের বোর্ড, বক্স, প্যাকেট, চিঠিপত্র, খাম ইত্যাদি একটা সাদা/নীল স্বচ্ছ ব্যাগে আর কাচ ও টিনের জিনিস, লোহা, স্টিল ইত্যাদি পৃথক সাদা স্বচ্ছ ব্যাগে বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে ফুটপাতে রাখতে হবে। ইদানীং নিয়ম হয়েছে শুধু ব্যাগে রাখলেই চলবে না, ব্যাগটিকে একটা বিনের মধ্যে রাখতে হবে। শহরের একজন বাসিন্দাকে কতটুকু দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়, সেটা বোঝানোর জন্যই এত কথা বললাম। কাজটা মোটেই সহজ নয়। যিনি এই কাজটি করেন, তিনি জানেন কাজটা কতটা কষ্টের।
নিউ ইয়র্কে প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই তিন থেকে চারটা বিন থাকে। যেখানে ঘরের ময়লাগুলোকে পৃথক করে প্রথম থেকেই সাধারণ বর্জ্য, কাচ লোহা এবং কাগজ জাতীয় এই তিনটিকে আলাদা করা হয়। এর বাইরে চতুর্থ বিনে পচনশীল যেমন খাবার, লতাপাতা ইত্যাদি রাখা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই অনেকে এগুলোকে একটার সঙ্গে অন্যটা মিশিয়ে ফেলেন। কিন্তু পরিবারের যিনি এই কাজটি করেন, তার দায়িত্ব সেগুলোকে বেছে আলাদা করে যথাযথ ব্যাগে এবং বিনে রাখা। চার-পাঁচ দিনের পুরনো ময়লা ঘাঁটা কতটা অস্বস্তিকর তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক কাজ আছে। এগুলোকে গোছাতে হয়, বাঁধতে হয়। এই কাজের জন্য ব্যবহার সামগ্রী নিজ খরচেই জোগাড় করতে হয়। আপনি যেনতেনভাবে কাজটা করতে পারবেন না। ময়লা যদি রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে যায়, তাহলে জরিমানা হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলি, তোশক মানে ম্যাট্রেস ফেলতে হলে, সেটিকে নিিদ্র স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগে প্যাক করে ফেলতে হবে। কারণ ম্যাট্রেসে ছারপোকা থাকতে পারে। প্যাকেট না করলে তা অন্যত্র ছড়াবে। নিয়মমতো না ফেললে জরিমানা এবং স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্ট সেটা নেবেও না। এবার নিউ ইয়র্ক সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু কথা বলি। নিউ ইয়র্ক সিটির বাসিন্দারা প্রতিদিন প্রায় ৪৪ মিলিয়ন পাউন্ড বর্জ্য উৎপন্ন করেন, যার মধ্যে প্রায় ২৪ মিলিয়ন পাউন্ড সংগ্রহ করে সিটির স্যানিটেশন বিভাগ (উঝঘণ)। এই বর্জ্য তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয় :সাধারণ বর্জ্য, পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এমন বর্জ্য ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য : কাগজ, ধাতু, প্লাস্টিক ইত্যাদি। জৈব বর্জ্য : খাদ্য ও উদ্ভিজ্জ বর্জ্য।
২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে জৈব বর্জ্য পৃথক করে কম্পোস্টিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাসিন্দাদের খাদ্য ও উদ্ভিজ্জ বর্জ্য পৃথকভাবে নির্ধারিত ব্রাউন বিনে ফেলতে হয়। এই উদ্যোগ শহরের ইঁদুর সমস্যা মোকাবিলা ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে। তবে কিছু বাসিন্দা ও ভবন সুপারিনটেনডেন্টরা এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে, ১০ ইউনিটের কম আবাসিক ভবনগুলোর জন্য আবর্জনা সুরক্ষিত ঢাকনাযুক্ত বিনে সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই নিয়মের উদ্দেশ্য হলো, রাস্তার আবর্জনা কমানো ও ইঁদুরের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এই নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য ৫০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৫,০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে ঢাকা শহরে প্রায় ৬,৫০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। ইন্টারনেট থেকে এমন তথ্যই পেয়েছি। শহরাঞ্চলে গড়ে প্রায় ৫৫% কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় না, যার ফলে পরিবেশদূষণ, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভালো খবরও আছে। একটি সংস্থা কমিউনিটি-ভিত্তিক কম্পোস্টিং মডেল ব্যবহার করে দৈনিক প্রায় ১০০ টন বর্জ্যকে জৈব সার হিসেবে রূপান্তর করছে। আরও একটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। ২০২১ সালে কঠিন বর্জ্য, বিপজ্জনক বর্জ্য এবং ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। যে বিষয়টি নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলব, সেটি বলার আগে এই কথাগুলো বলার দরকার আছে। তা না হলে মনে হতে পারে, আমি হয়তো সবাইকে দায়িত্ব শেখাতে চাইছি। আসলে তা নয়, নিউ ইয়র্ক থাকলে আপনিও এই কাজগুলো করবেন। আর দেশে থাকলে আমি কিংবা আপনিও অনেক দরকারি কাজ করি না বা না করেও পারি। বলতে চাইছি, কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
কোরবানি এলেই সিটি করপোরেশন ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বাড়তি লোকজনকে কাজে লাগায়, অতিরিক্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে ময়লা সরানোর। এতে শহরের বাসিন্দা হিসেবে আমরা খুশি হই। আর সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভা যদি কাজটা সময়মতো না করে তাহলে আমরা বিরক্ত হই, উষ্মা প্রকাশ করি। আমাদের কেউ কেউ আবার এটাও বোঝাতে চাই যে, আমরা তো ট্যাক্স দেই, তাই এ দায়িত্ব তো সরকারের! এ কথা হলফ করেই বলা যায় যে, উন্নত বিশ্বের সাধারণ মানুষ আমি আবার বলছি সাধারণ মানুষ ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ তেমন একটা পায় না। কিন্তু তারপরও ময়লা পরিষ্কারে তাদের সক্রিয়ভাবে স্যানিটেশন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। তাই প্রশ্ন এসে যায়, আমরা কি আমাদের দায়িত্বটা পালন করি? খুব ঢালাওভাবে যদি বলি উত্তর হবে, করি না। কেন করি না? উত্তর হলো, না করলে আমাদের কেউ প্রশ্ন করে না। এমন কি সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারও না। আপনি যদি আপনার বাড়ির সামনে কোরবানি করে তার রক্ত ভালোভাবে পরিষ্কার না করেন এবং তা থেকে সৃষ্ট দূষণের জন্য কোনো সাধারণ মানুষ আপনাকে প্রশ্ন করে বিবাদে জড়াতে চাইবে না। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ কি নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসে একটা অভিযোগনামা পেশ করতে পারে? পারে না। বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে সে ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি।
তাহলে আমরা কী করতে পারি? সিটি করপোরেশন যখন ময়লা পরিষ্কারের কার্যক্রম গ্রহণ করে তখন তার সঙ্গে বাসিন্দাদের যুক্ত করতে পারে, তাদেরও কিছু দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারে। এই দায়িত্বের মধ্যে থাকবে কোরবানির বর্জ্য বিশেষ করে রক্ত সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে ড্রেন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। এই দায়িত্ব যারা কোরবানি দেবে তাদের। সেই সঙ্গে অন্যান্য বর্জ্য বড় বড় কালো গার্বেজ ব্যাগে ঢুকিয়ে মুখটা প্লাস্টিকের লক অথবা শক্ত করে বেঁধে বাড়ির এক পাশে স্তূপ করে রেখে দিতে হবে। এতে করে সিটি করপোরেশনের লোকজন দ্রুত গাড়ি নিয়ে এসে ময়লার ব্যাগগুলো দ্রুতই সরিয়ে ফেলতে পারবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে, কোরবানি দেওয়ার জন্য সব ধরনের সুবিধাসহ স্থায়ী পশু জবাই সেন্টার বানিয়ে যেখানে সেখানে কোরবানি দেওয়া নিষেধ করতে পারে সিটি করপোরেশন। এসব সেন্টারে কোরবানি দেওয়ার জন্য একটা ফি থাকবে এবং আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখতে হবে। এই ব্যবস্থা সারা দেশেই চালু করা যেতে পারে। পশু জবাইয়ের বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে সরকার বায়োগ্যাসের প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারে। পাশাপাশি নগরবাসী খুব দ্রুত স্বস্তিকর পরিবেশ ফিরে পাবে, কমবে রোগজীবাণু বেড়ে ওঠার সুযোগ এবং রোগবালাই। সেই সঙ্গে থাকতে হবে আইনের কঠোর বিধান। স্যানিটারি ইন্সপেক্টর অকুস্থল পরিদর্শন সাপেক্ষে ফোন দিয়ে ভিডিও এবং স্থির ছবিকে প্রমাণ হিসেবে রেখে বাড়ির ফটকে তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানার কাগজ সেঁটে চলে যেতে পারেন।
নাগরিকের থাকবে আপিল করার ব্যবস্থা। এক সপ্তাহের মধ্যেই লিখিত অভিযোগনামাসহ জরিমানা পরিশোধের অনুরোধ সংবলিত চিঠি আসবে। সময়মতো পরিশোধ না করলে সমন জারি হবে। পুরো ব্যাপারটা যেন একজন নাগরিক অনলাইনে সময় বাঁচিয়ে করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কাজগুলো এখনকার দিনে কঠিন কিছু না। এর আগে সাপ্তাহিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে এবং জরিমানার বিধান থাকলে, কোরবানির সময় ময়লা-আবর্জনা সরাতে সিটি করপোরেশনকে আর তেমন বেগ পেতে হবে না। শুধু দরকার, আন্তরিকতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। তবে বাসিন্দাদের যুক্ত করলেই হবে না। ময়লাগুলো কোথায় যাবে? কীভাবে প্রসেসড হবে? সেখানকার পরিবেশ দূষিত হবে কি না? ইত্যাদি আরও অনেক বিষয় নিয়ে সরকারকেই কাজ করতে হবে। সরকার যদি তার করণীয় বিষয়গুলোকে নিশ্চিত না করে তাহলে সাধারণ মানুষকে এই কার্যক্রমে যুক্ত করার কোনো মানে হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, কোনো রাজনৈতিক দল কী তাদের ইশতেহারে এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বলেছে? বলেনি। তারা তিলোত্তমা নগরী গড়তে চান, কিন্তু ময়লা ব্যবস্থাপনার কোনো আদ্যোপান্ত পরিকল্পনা নিতে পারেন না। সুন্দর ঘরে সুন্দর কিচেন, সুন্দর টয়লেট থাকতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সেই টয়লেট ব্যবহার করতে জানতে হবে। কাজ সারার পর ফ্ল্যাশ করে নিশ্চিত হতে হবে, সেটা পরিষ্কার হলো কি না। বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি খাত এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন সেই জোরালো সুস্থ চিন্তা, যা নাগরিক ও সরকার উভয়ের মধ্যে সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা তৈরি করবে। আসন্ন কোরবানি ঈদ হোক শান্তিময় এবং সৌহার্দ্যরে। ঈদ মোবারক।
লেখক: চিকিৎসক ও কলাম লেখক
[email protected]