যুক্তরাষ্ট্রের সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না বিশে^র শীর্ষ ধনী ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকে রিপাবলিকানদের হয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। ডেমোক্র্যাট পার্টির সমালোচনার তো ছিলই, এমনকি ট্রাম্পের সমর্থনে প্রচারণায় প্রায় ৩০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন স্পেস এক্স ও টেসলার প্রধান নির্বাহী। নির্বাচনে জয়ের পর ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিলাসবহুল মার এ লাগো রিসোর্টে একান্ত সময় কাটিয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে ট্রাম্প সরকারি সক্ষমতা বিভাগ নামে একেবারে নতুন এক দপ্তর পরিচালনার দায়িত্বে দেন মাস্ককে। তবে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বদলে গেছে চিত্র। গত সপ্তাহে ১২৯ দিন দায়িত্ব পালন শেষে হঠাৎ করেই ট্রাম্প প্রশাসন থেকে বিদায় নেন মাস্ক। আর বিদায়ের পর এবার প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন তার বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ইলন মাস্ক। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বাজেট ও করছাড় বিষয়ক বিলকে ‘জঘন্য ও ন্যক্কারজনক’ আখ্যা দিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন মাস্ক।
বিতর্কিত এই বাজেট বিলটি গত মাসে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে (২১৫-২১৪) যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পাস হয়েছে। যদিও রিপাবলিকানদের সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে (২২০ আসন), কিন্তু কয়েকজন সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন বা ভোট দেননি। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটদের সবাই অর্থাৎ ২১২ জন সদস্যই এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। মাত্র দুজন রিপাবলিকান-থমাস ম্যাসি ও ওয়ারেন ডেভিডসন নিজ দলের বিপক্ষে গিয়ে বিলের বিরোধিতা করেন। বিলটিতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের করছাড়, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই বিলকে ট্রাম্পের সম্ভাব্য দ্বিতীয় মেয়াদের ‘মূল পরিকল্পনা’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ মাস্ক বলেন, যারা এই বিলে ভোট দিয়েছেন, তাদের লজ্জা হওয়া উচিত। সরকার ছাড়ার পর এই প্রথমবার ট্রাম্পের সঙ্গে প্রকাশ্যে মতবিরোধ জড়ালেন মাস্ক। এর আগে তিনি বিলটিকে ‘হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। গত মঙ্গলবার একাধিক এক্স পোস্টে মাস্ক বলেন অত্যন্ত অপচয়পূর্ণ ও নিজ স্বার্থে ভরা এই বিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতিকে বাড়িয়ে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাবে এবং দেশের নাগরিকদের ওপর এক ধরনের অসম্ভব ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেবে। যদিও ট্রাম্প বিলটিকে ‘বড় সুন্দর বিল’ বলে অবহিত করেছেন। বিল নিয়ে মাস্কের সর্বশেষ মন্তব্য নিয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, এই বিল নিয়ে ইলন মাস্কের অবস্থান সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট আগে থেকেই জানেন। তিনি আরও বলেন, এই বিলটি এক কথায় বড় সুন্দর একটি বিল। প্রেসিডেন্ট তা কার্যকরে অটল আছেন।
কংগ্রেসনাল বাজেট কার্যালয়ের মতে, এটি কার্যকর হলে ইতিমধ্যে ৩৬ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন সরকারি ঋণের বোঝার ওপর আরও বাড়তি ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ যুক্ত হতে পারে। এই বিলটি ৪ জুলাইয়ের মধ্যে পাস করিয়ে আইনে পরিণত করার লক্ষ্য ঠিক করেছেন ট্রাম্প ও কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা। মাস্কের মন্তব্য রিপাবলিকান দলের ভেতরে বড় মতভেদের ইঙ্গিত দিয়েছে। বিলটি হাউজে পাস হওয়ার সময়ই দলের ভেতরে ভিন্ন মত দেখা গিয়েছিল। এখন সেটি সিনেটে উঠেছে, যেখানে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুবই কম। সেখানে ইতিমধ্যেই বিভক্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
কেনটাকি রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল স্পষ্ট করে বলেছেন যদি বিলটি ঋণসীমা বাড়ায়, তবে তিনি এতে সমর্থন দেবেন না। সিবিএস নিউজকে তিনি বলেন, এই বিল পাস হলে ঋণের দায় পুরোপুরি রিপাবলিকানদেরই নিতে হবে। জবাবে ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে র্যান্ড পলকে আক্রমণ করে বলেন, তিনি এই বিল সম্পর্কে খুব সামান্যই বোঝেন। ট্রাম্প দাবি করেন, কেনটাকির মানুষ তাকে সহ্য করতে পারেন না। ট্রাম্প আরও লেখেন, তার চিন্তাধারাগুলো আসলেই পাগলাটে। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে অনেকে, যদিও এর আগে মাস্ক ও তার সরকারি দক্ষতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত দপ্তর এর কাজের সমালোচক ছিলেন, এখন তার বক্তব্যকে স্বাগত জানাচ্ছেন। সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার বলেন ইলন মাস্ক পর্যন্ত বলেছেন বিলটি খারাপ; যিনি পুরো প্রক্রিয়ার একজন অংশ ছিলেন, যিনি আবার ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, বিলটি কতটা খারাপ। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে মাস্কের প্রভাব যাচাই করা যাবে।
মাস্কের মন্তব্যকে ঘিরে রিপাবলিকান সিনেটররাও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জন থুন সাংবাদিকদের বলেন, মতবিরোধ থাকলেও আমরা পূর্ণ গতিতে এগোচ্ছি। তিনি বলেন, এই এজেন্ডা আমাদের প্রচারণার অন্যতম ভিত্তি ছিল, বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের। বিলটি পার্লামেন্টে পাস করানো হাউজ স্পিকার মাইক জনসন সাংবাদিকদের বলেন, আমার বন্ধু ইলন একদম ভুল করেছেন। তিনি আরও বলেন, এই বিলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। ইলন বিষয়টি একদমই বুঝতে পারছে না। জনসন জানান, বিলটি নিয়ে সোমবার তিনি মাস্কের সঙ্গে ২০ মিনিটের ফোনালাপ করেছেন। এতে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির কর ছাড় ধীরে ধীরে তুলে নেওয়ার বিষয়টি টেসলার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জনসন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ রকম কিছু যে হবে তা একেবারেই ভাবতে পারিনি। ফোনালাপের পরেও মাস্ক কেন প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেন, তা বুঝতে পারছি না। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে সে এমন ভুল করেছেন।
অ্যাক্সিওসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাস্ক যে কয়েকটি বিষয়ে ক্ষুব্ধ তার একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। মাস্ক চাইছিলেন, এটি যেন তার স্টারলিংক স্যাটেলাইট ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কিন্তু প্রযুক্তি গত সীমাবদ্ধতা ও স্বার্থ সংঘাতের শঙ্কায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। সরকারি ব্যয় কমানো নিয়ে আপসহীন যেসব রিপাবলিকানকে খুশি রাখতে চান ট্রাম্প, তাদের জন্যও তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেছেন। এতে ৯.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা রয়েছে, যা মূলত মাস্কের ‘ডোজ’ টিমের বিশ্লেষণ থেকে নেওয়া। এই প্রস্তাবে বিদেশি সাহায্য, ইউএসএআইডি, এবং এনপিআর ও পিবিএস-এর মতো সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর বাজেট ছাঁটাই করার কথা বলা হয়েছে।
আগের মেয়াদেও ব্যাপক কর ছাড়ের একটি বিল নিয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন ট্রাম্প। ২০১৭ সালে ট্রাম্পের সেই বিলের বিস্তৃত রূপ হিসেবে নতুন প্রস্তাবটি তৈরি করা হয়েছে। এই আইনে প্রথম মেয়াদে পাস হওয়া কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সরকারের বিশেষ কর্মী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচনে তার ব্যাপক অঙ্গীকারের প্রায় কিছুই অর্জন করতে পারেননি ইলন মাস্ক। রিপাবলিকান সিনেটর স্টিভ ডেইনস জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের করনীতি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিনেট ফাইন্যান্স কমিটির রিপাবলিকান সদস্যরা ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে বুধবার বিকেলে হোয়াইট হাউজে যান। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাদের আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যবসা সংক্রান্ত করছাড় স্থায়ীকরণের বিষয়টি। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই দাবি মেনে নেওয়া হলে সরকারের ব্যয় আরও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে বলে।